শিক্ষার্থীদের প্রহার নয় by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাবান্ধব আনন্দদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে
শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকার সুবাদে অভিভাবকদের নানা অনুযোগ ও অভিযোগ কর্মজীবনের নিত্যসঙ্গী। অভিভাবকদের অভিযোগের অন্যতম হলো শিক্ষার্থীদের প্রহারজনিত। অথচ শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামও নির্দয়ভাবে শিক্ষার্থীদের প্রহারকে সমর্থন করে না। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অন্যায়, ভুল কিংবা পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর জন্য সংশিল্গষ্ট শিক্ষার্থীর অভিভাবকের পাশাপাশি সংশিল্গষ্ট শিক্ষকরাও সহনীয় মাত্রায় শিক্ষার্থীকে শাসন করে থাকেন। এটা নিয়ে অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন নন; কিন্তু শিক্ষার্থীদের বেদম প্রহার করে জখম করা কিংবা পিটিয়ে মেরে ফেলার মধ্যে কী মঙ্গল থাকতে পারে, এটা বোধগম্য নয়। শিক্ষার্থীর মঙ্গলকামী কোনো শিক্ষক এমন জঘন্য কাজ করতে পারেন না। শিশুদের বা অন্য কাউকে প্রহার করা সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে কিয়ামতের দিন তার থেকে এর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে।'-তাবারানি আল্লামা ইবনে খালদুন ছাত্রদের প্রহার ও কঠোরতাকে ক্ষতিকর বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'প্রহার ও কঠোরতার কারণে শিশুদের মাঝে মিথ্যা বলার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। তাদের আত্মমর্যাদাবোধ ও উচ্চ চেতনা দূর হয়ে যায়। শিক্ষকের মারধর থেকে বাঁচার জন্য তারা নানা অপকৌশল, মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে এসব ত্রুটি তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যায়। উত্তম চরিত্র ও সুন্দর মানসিকতার পরিবর্তে অসৎ চরিত্র ও অনৈতিকতার ভিত রচিত হয় তাদের মাঝে।' আমাদের শিক্ষকের মনে রাখা দরকার, শরিয়তের দৃষ্টিতে শিশুরা সব ধরনের দায়ভার ও জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত। তারা শারীরিকভাবে যেমন দুর্বল তেমনি মানসিকভাবেও কোমল। তাই তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করতে হবে। তাদের শিক্ষাদান করতে হবে স্নেহ-মমতা দিয়ে। এ ক্ষেত্রে কঠোরতা পরিহার করে নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করতে হবে। হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'আল্লাহতায়ালা কোমল আচরণকারী, তিনি সর্বক্ষেত্রে কোমলতাকে ভালোবাসেন।' -সহিহ বোখারি
ইমাম মুহিউদ্দীন নববি (রহ.) শিক্ষকের জন্য করণীয় বিষয় সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় বলেন, 'শিক্ষকের উচিত তার ছাত্রের সঙ্গে নরম ব্যবহার করা, তার প্রতি সদয় হওয়া। তার কোনো ভুল হলে বা অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রকাশ পেলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। বিশেষত শিশু-কিশোরদের বেলায়।' আগেকার দিনের শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহে শিক্ষা গ্রহণ করত। সেখানে শিক্ষক পরম স্নেহে ছাত্রকে শিক্ষা প্রদান করতেন। শাসন করতেন, তবে তা সীমা ছাড়িয়ে যেত না। তাদের শাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীকে আদর্শবান করে গড়ে তোলা। বর্তমানে শিক্ষা অর্জনের সে পরিবেশ ও মনমানসিকতা যে একেবারে বিলীন হয়ে গেছে তা নয়। সরকারি-বেসরকারি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও শিক্ষার্থীরা পরমানন্দে শিক্ষা অর্জন করছে। সেখানে প্রচুর শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন, যারা অপত্য স্নেহে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে থাকেন। এ কারণে প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, ভালো বিদ্যালয় শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে বাড়ির চেয়েও আপন। সেখানে শিক্ষকদের স্নেহ-ভালোবাসায় কঠিন বিষয়ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। হাসি-আনন্দে সময় কাটে শিক্ষার্থীদের।
শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভীতিকর স্থানে পরিণত করার প্রবণতাকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা সেখানে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করলে আর যা-ই হোক শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে না। শিক্ষার্থীদের প্রতি একশ্রেণীর শিক্ষকের এই আচরণ সম্পূর্ণ অমানবিক। এ বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক সংগঠন, অভিভাবক ও প্রশাসনসহ সংশিল্গষ্ট সবাইকে তৎপর হতে হবে। শিক্ষক নামধারী কোনো মায়া-মমতাহীন ব্যক্তির স্থান যাতে শিক্ষায়তনগুলোতে না হয় সে ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে রাগান্বিত অবস্থায় শিশুদের প্রহার করা অন্যায়। এ প্রসঙ্গে এক হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'তোমরা শিক্ষাদান করো, সহজ ও কোমল আচরণ করো; কঠোর আচরণ করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক (এ কথা তিনবার বললেন)।' -মুসনাদে আহমদ
শিশু শিক্ষার্থীদের প্রহার সম্পর্কে হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, 'কখনও রাগান্বিত অবস্থায় শিশুকে প্রহার করবে না। পিতা ও শিক্ষক উভয়ের জন্যই এ কথা।' বিখ্যাত ইসলামী স্কলার মুফতি শফি (রহ.) বলেছেন, 'শিশুদের প্রহার করা খুবই ভয়াবহ। অন্যান্য গুনাহ তওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের ওপর অত্যাচার করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা এটা হচ্ছে বান্দার হক। আর বান্দার হক তওবার মাধ্যমে মাফ হয় না_ যে পর্যন্ত না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ করে। এদিকে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে সে হচ্ছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক। অপ্রাপ্ত বয়স্কের ক্ষমা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এ জন্য এ অপরাধের মাফ পাওয়া খুবই জটিল। তাই শিশুদের প্রহার করা এবং তাদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করার বিষয়ে সাবধান হওয়া দরকার।'
শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে এসব ধর্মীয় দিকনির্দেশনা ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি বাদ দিলেও শিশুদের প্রহারের অশুভ প্রতিক্রিয়া সমাজে নানাভাবে পরিলক্ষিত হয়। যেমন যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, শিক্ষার্থী প্রহারের দু'একটি ঘটনা তার সুনাম নষ্ট করে দেয়। সে সঙ্গে শিশুদের শিক্ষার প্রতি বিরূপ মানসিকতা সৃষ্টি হয়। ফলে এ অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে, বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যেতে চায় না_ শিক্ষকের মারধর ও কঠোরতার কারণে। অন্যদিকে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের ব্যাপারেও এ দুর্নাম রটে যায় যে, তারা সবাই ছাত্রদের প্রহার করেন। গুটিকয়েক শিক্ষকের জিঘাংসা ও অজ্ঞতামূলক আচরণের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজকে দুর্নাম বহন করতে হয়। তাই আমরা আশা করব, আমাদের শিক্ষকরা শিশু শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে সহনীয় আচরণ করবেন, কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীর স্নেহ, ভালোবাসা ও মায়া-মমতা দিয়ে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণে সচেষ্ট হবেন। নতুন শিক্ষা বছরের সূচনালগ্নে শিক্ষক সমাজের কাছে এ প্রত্যাশা রইল।
মুফতি এনায়েতুল্লাহ : শিক্ষক ও কলাম লেখক
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.