সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উত্তরাধুনিক ছোটগল্প by তুষার তালুকদার

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম [জন্ম :১৮ জানুয়ারি ১৯৫১]
সমকালীন বাংলা সাহিত্যে ভাষা-দুর্বলতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও গবেষণার অভাব মাড়িয়ে যে ক'জন ছোটগল্পকার পাঠকহৃদয়ে বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অন্যতম। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে জানান, গল্প বলায় ও লেখায় একটা সূক্ষ্ম তফাত আছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যে রয়েছে গল্প বলার ঐতিহ্য; লেখার নয়। আর পাশ্চাত্যে রয়েছে গল্প লেখার ঐতিহ্য। গল্প বলতে গেলে ভাষার মৌখিকতাকে প্রাধান্য দিতে হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের কথা বলেছেন। বাংলা সাহিত্যের মতো লাতিন আমেরিকার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে রয়েছে গল্প বলার ঐতিহ্য। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলা সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরে বিদ্যমান ওই গল্প বলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন। তাই তার অধিকাংশ গল্পে আছে গল্প বলা ও লেখা উভয় ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মিশ্রণ, যেমনটি আমরা পেয়ে থাকি উত্তরাধুনিক গল্পকথক মার্কেজ কিংবা বোর্হেসের মাঝে। তাই তাকে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে উত্তরাধুনিকতার অন্যতম প্রবর্তক বললে অত্যুক্তি হবে না।
২. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রতিটি গল্পই সমাজে বিদ্যমান মানুষের সমস্যার সফল রূপায়ণ। সমকালীন সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, রাজনীতি_ সবকিছু লেখকের বর্ণনার পরিসরভুক্ত। এ যাবত তার প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন সংখ্যা ৮। তবে এ আলোচনায় তার রচিত 'প্রেম ও প্রার্থনার গল্প' এবং 'সুখদুঃখের গল্প'_ এ দটো সংকলন থেকে কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করব। উপর্যুক্ত সংকলনদ্বয়ের গল্পে লেখকের চরিত্র নির্মাণে এক ধরনের বিচিত্রতা ও ব্যাপ্তি বিদ্যমান। প্রেম ও প্রার্থনার গল্প সংকলনের গল্পে আমরা নানা শ্রেণী-পেশা মানুষের বর্ণনা পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে মজুর পর্যন্ত। এ থেকে তার শ্রেণী-বৈষম্যহীনতা ও মানব সচেতনতার পরিচয় প্রতীয়মান। আধুনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা আর নিঃসঙ্গতা, সুখ ও অসুখের মননশীল প্রকাশ এই সংকলনের প্রতিটি গল্প। এসব সংবেদী গল্পে জীবন ও জীবনহীনতা একইভাবে মূর্ত হয়। আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা, হতাশা আর সমস্যা দিয়ে লেখকের প্রায় অধিকাংশ গল্পের শুরু। আবার এসব সমস্যা সমাধানে লেখক নিজেই সচেষ্ট ভূমিকা রাখেন। তার গল্পের প্রায় চরিত্রই গল্প শেষে এক ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করে। অতীত ও বর্তমানের মিশেলে বর্তমান বাস্তবতাকে উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করে থাকেন সৈয়দ ইসলাম। মানব-মনের চেতন ও অবচেতন দিক উন্মোচনেও তিনি অত্যন্ত পারদর্শী। নগর জীবনের দ্বান্দ্বিকতা তার গল্পে সব সময় খুব প্রাসঙ্গিক।
গল্পগুলো কেমন_ তার উদাহরণ হিসেবে প্রেম ও প্রার্থনার গল্প ও সুখদুঃখের গল্প গ্রন্থ দুটি থেকে কয়েকটি গল্প নিয়ে একটু বিস্তারিত আলাপ করা যাক।
৩. প্রেম ও প্রার্থনার গল্প ছোটগল্প সংকলনের 'ডিডেলাসে ঘুড়ি' গল্পে হোসেন মিয়ার গ্যারেজের কর্মচারী ইনাম লুকিয়ে ঘুড়ি ওড়ায়। যদিও ইনাম জানে, তার বাবা সেতু মিয়া ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে মারা গেছেন। হোসেন মিয়া নিজেও অপছন্দ করেন ঘুড়ি ওড়ানো। কারণ ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে তার বড় ভাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। সাংবাদিক আবদুল মুয়ীদ তালুকদার হোসেন মিয়ার গ্যারেজে তার ভেস্পা ঠিক করতে দেন। হোসেন মিয়া ছুটির দিন থাকা সত্ত্বেও মুয়ীদ ভাইয়ের ভেস্পা রেভ দিয়ে দেন। কারণ সাংবাদিক মুয়ীদ তালুকদার হোসেন মিয়ার গ্যারেজ মেয়র সাহেবের লোকজনের হিংস্র থাবা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এভাবেই শুরু গল্প। লেখক ঢাল্কা বাজারের ঘুড়ি তৈরির অন্যতম স্রষ্টা সেতু মিয়াকে গ্রিক পুরাণের ডিডেলাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ইনাম গ্যারেজে তার হাতের কাজ সেরে আবার ঘুড়ি ওড়াতে চলে যায়। কিন্তু হায়! ঘুড়ি কানি্নর অভাবে শুধু ডান দিকে কানাচ্ছে। ইনাম এই ত্রুটি পূর্বে লক্ষ্য করেনি। ঘুড়ি মাঠের পার্শ্ববর্তী পাঁচ তলা ফ্ল্যাটের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছে আটকে যায়। ঘুড়ি আনতে গিয়ে ইনাম একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পায়। সে দেখতে পায় ঢাল্কা বাজারের সবার চেনা দারোগা সাহেব উলঙ্গ মেয়েটিকে জাপটে ধরেছে। জাপটে ধরার পূর্বে মেয়েটি সাহায্য চেয়েছিল ইনামের কাছে। পরক্ষণেই সে ব্যালকনিতে দারোগা ও তার স্ত্রীকে দেখল। তারা দু'জনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে মেয়েটিকে। ইনাম মুয়ীদ ভাইকে সব জানাল। মুয়ীদ ভাই কণ্ঠে ও লেখায় তীব্র প্রতিবাদ জানাল। এবং আছমা হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করল। গ্রেফতার হলো অবসরপ্রাপ্ত দারোগা কলিমুল্লাহ্ ও তদীয় স্ত্রী আলেফা বেগম। তবে সত্যধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন দেখল রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট দারোগা ও তার স্ত্রী দ্রুত ছাড়া পেল। বরং মামলার নতুন চার্জশিট হলো। এতে ইনামকে দারোগা সাহেবের ঘরের মূল্যবান সামগ্রী চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। বলা হলো, 'ছেলেটা গাছ বেয়ে উঠত, আর আছমা পুঁটলা চালান দিত।' লেখক এ গল্পে সমকালীন রাজনীতির একটি অন্তঃসারশূন্য চিত্র অংকন করেছেন। আবার 'তারা ভাবে তারা সাপ, আসলে তারা রজ্জু' গল্পে লেখক দর্শনের শিক্ষক ওয়াকিলুর রহমানকে দাঁড় করান সমকালীন রাজনীতিতে নৈতিক স্খলনের বিপক্ষে একজন আদর্শনির্ভর মানুষ হিসেবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বর্তমান রাজনৈতিক দর্শন ও নৈতিকতার অধঃপতন লক্ষ্য করে দর্শনশাস্ত্র পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছেন। লেখক তার নিজস্ব দর্শনচিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন ওয়াকিলুর রহমানের দর্শন-ভাবনার মধ্য দিয়ে। গল্পে ওয়াকিলুর রহমানের শ্যালক একজন রাজনীতিবিদ। দেশে অপারেশন ক্লিনহার্ট শুরু হওয়ার পর তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। সহজে বোঝা যায়, রাজনৈতিক কোনো দৃঢ় আদর্শ ও নীতিবোধ তার ছিল না। তা না হলে পালানোর কী দরকার ছিল! লেখক এ প্রসঙ্গে ওয়াকিলুর রহমানের মাধ্যমে বলেছেন, 'বাংলাদেশের মানুষ যদি দর্শনশাস্ত্রকে জননী শাস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করত, তাহলে এই অপারেশনের প্রয়োজন হতো না।' লেখকের এই গল্পটি খুবই সিম্বলিক। তবে গল্পটির মূল প্রসঙ্গ ছিল একটাই_ রাজনীতিবিদরা নিজেদের সাপ ভাবলেও আসলে তারা রজ্জুবৎ, অর্থাৎ দড়ি।
৪. এবার বলি সুখদুঃখের গল্প সংকলনের কথা। যেহেতু সুখ-দুঃখ নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় অবধারিত উপাদান, তাই নিরবচ্ছিন্ন সুখ কিংবা দুঃখ কোনোটিই মানুষের জীবনে সম্ভব না। সুখ ও দুঃখের দোলাচলে মানবজীবনে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় নানা উত্থান-পতন। সুখদুঃখে আছে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন। আছে পাওয়ার সুখ, না পাওয়ার বেদনা। আছে কাম-ভোগ-বাসনা। রয়েছে রহস্যে ঘেরা মানব-মন। উত্তর-আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য সংবলিত সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রায় প্রতিটি গল্পের ভিত্তি শোনা বা দেখা ঘটনা। বলার অপেক্ষা রাখে না, শহীদুল জহিরের পর, সমকালীনদের মধ্যে তিনিই সর্বাপেক্ষা সফল উত্তরাধুনিক গল্প তৈরিতে। সুখদুঃখের গল্প সংকলনটির গল্পগুলো বাস্তব-অবাস্তব আর জাদুবাস্তবতার মিশেলে পরিবেশিত। নগর আর প্রান্ত বাংলার মানুষ গল্পগুলোর কুশীলব। সুখদুঃখের মনস্তাত্তি্বক বিশ্লেষণও গল্পগুলোতে পাওয়া যায়। মনজুরুল ইসলাম চেষ্টা করেছেন কারণের অন্তরালে যে কারণ তা খুঁজে বর্ণনা করতে। গল্পের চরিত্রগুলো সত্য-অসত্য, নৈতিকতা-অনৈতিকতা দিয়ে ঘেরা। উত্তর-আধুনিকতাবাদের যে বিষয়গুলো গল্পগুলোতে স্পষ্ট তা হলো, চরিত্র নির্মাণে গবেষণা, গতানুগতিক গল্পকাঠামো ও চরিত্র নির্মাণে অনাগ্রহ, গল্প কথনে নতুন ধারা সৃষ্টি, যরনৎরফরঃু ড়ভ পঁষঃঁৎব, মেদহীন বাক্যবিন্যাস এবং শব্দশক্তি উদ্ঘাটন।
৫. পাঠকের আগ্রহ নিবৃত্তায়নে সুখদুঃখের গল্প সংকলন থেকে দু'একটি গল্পের কিছু দিক নিয়ে আলাপ করা যাক । প্রথমেই বলি 'এক জীবন' গল্পটির কথা। গল্পটি বিভিন্ন চরিত্রের বিরতিহীন চৈতন্যপ্রসূ অভিজ্ঞতা ও ভাবনাচিন্তা নিয়ে তৈরি। মূলত এটি একটি কৌশল, যাকে ইংরেজি সাহিত্যে বলে ংঃৎবধস ড়ভ পড়হংপরড়ঁংহবংং ঃবপযহরয়ঁব. ইংরেজি সাহিত্যে এ কৌশল জেমস্ জয়েস ও ভার্জিনিয়া উলফ্ সফলভাবে ব্যবহার করেছেন । সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 'এক জীবন' গল্পে এই কৌশলটি ব্যবহার করেছেন। গল্পে খুব একটা বহির্মুখী কর্মস্পৃৃহা চোখে পড়ে না। যা ঘটে তার সবটুকুই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর মনোরাজ্যে ঘটে যাওয়া চেতন চিন্তার সম্মিলন। এ ধরনের গল্পে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । পুরো গল্পের সময়সীমা ভোর ৫টা থেকে রাত ১২.৩০-এর মধ্যে। গল্পকার অতি দ্রুত এক চরিত্রের ারবঢ়িড়রহঃ থেকে অন্য চরিত্রে যান। সময় ও চরিত্রগেিলার মনোরাজ্যে চেতন-চিন্তার মধ্যে এক ধরনের মেলবন্ধন তৈরি করেন। এ ধরনের ছোটগল্প লেখার অভিজ্ঞতা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি লেখকের নেই। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে রশীদ করিমের নাম, যিনি প্রাগুক্ত ধারায় গল্প-উপন্যাস তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। যেমন তার উপন্যাস 'উত্তম পুরুষ' উক্ত কৌশল অবলম্বনে লেখা। যা হোক, সুখদুঃখের গল্প সংকলনের আরেকটি অসামান্য গল্প 'মেয়ে'। লেখক এখানে সমকালীন সমাজে নারী স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার চিত্র দেখিয়েছেন। এবং একই সঙ্গে গল্প শেষে নারীর স্বাধীনচেতা রূপটিও দেখিয়েছেন। সামাজিক ভীতি, কুসংস্কার আর জড়তার ঊধর্ে্ব উঠে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তার দৃপ্ত প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এককথায়, সুখদুঃখের গল্প সংকলনে আছে বাবা-মা, ছেলেমেয়ের পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আছে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের অসহায়ত্ব। রয়েছে মানব-মানবীর শারীরিক ও অশরীরী প্রেম, আছে শুদ্ধ প্রেমাখ্যান। রয়েছে ভালোবাসা না থাকা সত্ত্বেও নারী-পুরুষের একত্রে দিনাতিপাতের কথা এবং আছে আশা-নিরাশার মাঝে বেঁচে থাকা একগুচ্ছ মানব-মানবীর গল্প।
৬. ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, সাহিত্য সমালোচনা ইত্যাদি বহুমাত্রিক সাহিত্য শাখায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের পদচারণা সমানভাবে বিস্তৃত। যদিও তিনি নিজেকে বহুমাত্রিক বলতে নারাজ। নিজেকে তিনি এমনকি কথাসাহিত্যিক হিসেবে মানতেও রাজি নন। তিনি নিজেকে কেবল গল্পকথক বলেন। পাঠক মহলে তিনি একজন অনবদ্য ছোটগল্পকার। লেখকের লেখা প্রতিটি ছোটগল্পেই তাই রয়েছে এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্যবোধের ছাপ। তার গল্পের প্রতিটি কাহিনীই প্রতীকাশ্রয়ী ও রূপক বর্ণনা। চলমান প্রতীকায়নে পাঠক কখনও গল্পের মূল কাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হন না। প্রতিটি গল্পে লেখকের উপস্থিতি আমাদের তার আপন বাস্তবতায় নিয়ে যায়। ফলে আমরাও তার গল্পের পাত্রপাত্রী বনে যাই। সর্বোপরি, অনেকটা নিদ্বর্ির্ধায় বলা যায়, বহুকাল পরেও ভাষাশৈলী, গল্প বলার ধরন, নির্মাণ কৌশল এবং থিমের অনন্যতার জন্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.