পুলিশ হত্যার তদন্তে পুলিশই ব্যর্থ! by সাহাদাত হোসেন পরশ

টানাপড়েনের সংসার ছিল পুলিশ কনস্টেবল মোজাহার আলীর। স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে কষ্টের সংসারে তবু সুখের কমতি ছিল না। বড় মেয়ে আয়েশা আক্তার মানসিক প্রতিবন্ধী। স্ত্রী উমেদা বেগমও দীর্ঘ দিন রোগে ভুগছেন। ভবিষ্যৎ সুখের আশায় বাকি তিন সন্তানের লেখাপড়ায় মোজাহারের আগ্রহে কখনও ছেদ পড়েনি। কিন্তু কে জানত, চরম অভাবের মধ্যে অসম্ভব জীবনবোধসম্পন্ন এই মানুষটিকে নৃশংসভাবে খুন হতে হবে! গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগাছায় পুলিশ কনস্টেবল মোজাহারের মাথায় কুপিয়ে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা বর্বর কায়দায় হত্যা করে। বাবার আঘাতের সেই দৃশ্যের কথা মনে করে মোজাহারের কলেজপড়ূয়া মেয়ে কোহিনুর আক্তার মিতি বলেন, 'বাবার মাথার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এভাবে মানুষ মানুষকে আঘাত করতে পারে! যারা আমার বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই। বিচার পেলে তবু মনকে সামান্য হলেও সান্ত্বনা দিতে পারব।' বাবাকে হারানোর পর মিতি খুনিদের বিচার চাইলেও এখনও মামলার তদন্তই শেষ করতে পারেনি পীরগাছা থানা পুলিশ। বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন কর্মসূচির সময় নিহত ১৫ জন পুলিশ সদস্যের পরিবার ও মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে নেই কোনো আশার আলো। পুলিশ হত্যা মামলাগুলো 'ডিপ ফ্রিজে' যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
শুধু কনস্টেবল মোজাহার আলী নন, মাসের পর মাস পার হলেও পুলিশ হত্যা মামলার তদন্ত পুলিশ বিভাগই করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত-শিবিরকর্মীদের হামলায় ১৫ জন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে ঢিলেঢালাভাবে। পুলিশের বাইরে দু'জন বিজিবি সদস্যও প্রাণ হারান। গড়িমসিভাবেই চলছে পুলিশি তদন্ত। গত ১১ মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের করা পুলিশ হত্যা মামলার একটিরও অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো মামলার আসামিকেও গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তদন্তের অগ্রগতি বলতে কোনো মামলা থানা পুলিশের ব্যর্থতার পর ডিবি ও পুলিশের বিশেষ অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর। স্বজনরা আশা-নিরাশায় বুক বেঁধে আছেন_ কবে তারা বিচার পাবেন! তবে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকায় তারা মামলা তদন্তে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারেননি। তবে সহকর্মীদের হত্যায় ঘটনায় খুনিরা যাতে প্রকৃত শাস্তি পায়_ এ ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। এদিকে জামায়াত-শিবিরের হামলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, যারা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করেছে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। পুলিশ হত্যা মামলায় তদন্তের স্বার্থে যা প্রয়োজন, আমরা তাই করব। পুলিশ সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা সব সময় জনগণের জন্য কাজ করছে। '৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে রাজারবাগে পুলিশের অকুতোভয় সদস্যরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সেই গর্বিত উত্তরসূরিদের ওপর এবারও নারকীয়ভাবে হামলা করা হয়েছে।
গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর থেকে দেশজুড়ে পুলিশকে টার্গেট করে হামলা করা হয়। সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে তিন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে জামায়াত-শিবির। এ ছাড়া গত বছরের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় পুলিশ সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বাংলামোটরে পুলিশের রিকুইজিশন করা গাড়িতে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হন পুলিশ কনস্টেবল ফেরদৌস খলিল। এভাবে গত ১১ মাসে সারাদেশে ১৫ জন পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই সহস্রাধিক। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। কেউ কেউ এখনও চিকিৎসা নিচ্ছেন। কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় বারবার পুলিশকে টার্গেট করা হয়। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ মাসে নিহত ১৫ পুলিশ সদস্যের মধ্যে ১৩ জন কনস্টেবল, একজন এসআই ও একজন নায়েক। তাদের মধ্যে অনেকে চিরজীবনের জন্য শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরই দেশব্যাপী জামায়াত-শিবির নারকীয় তাণ্ডব চালায়। এতে ৬৭ জন প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে সাতজন পুলিশ। গত ১১ মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হয় পুলিশের ওপর। কোথাও অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ঘটনাস্থলেই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় গাড়িতে পেট্রোল বোমা ছুড়ে হত্যা করা হয়েছে পুলিশ সদস্যকে।
যে পর্যায়ে পুলিশ হত্যা মামলার তদন্ত :গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে কনস্টেবল হযরত আলী, বাবুল মিয়া ও খাজা নাজিম উদ্দিনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করে পুলিশ। এই মামলায় স্থানীয় জামায়াত নেতা সাবেক এমপি সালেহ মো. আবদুল আজিজ, ইউনূস আলীসহ ৯৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। আসামি করা হয় অজ্ঞাত ছয়-সাত হাজার ব্যক্তিকে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা সমকালকে বলেন, তিন পুলিশ হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। কবে নাগাদ চার্জশিট দাখিল করতে পারব, এখনই বলা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংসতা মোকাবেলায় এখন আমাদের বেশি সময় দিতে হচ্ছে। এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকে পালিয়ে আছে। এর আগে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি যশোরের মনিরামপুরে নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল কাজী জহুরুল হক। এ ঘটনায় পুলিশের এসআই শরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে মনিরামপুর থানায় মামলা করেন। মনিরামপুর থানার ওসি মীর রেজাউল হোসেন জানান, মামলাটি তদন্তাধীন। গত বছরের ৫ মে ফকিরাপুলে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় পুলিশের এসআই শাহজাহানকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান জানান, মামলাটি তদন্তাধীন। ৬ মে রাতে কাঁচপুর এলাকায় নিহত হন নায়েক ফিরোজ খান। ২৬ ডিসেম্বর রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের হামলায় গুরুতর আহত হন পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকার। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলটির তদন্তও চলছে। গত বছরের ৯ মার্চ খুলনার কয়রায় নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল মফিজুর শেখ। এ ঘটনায় কয়রা থানায় দায়ের করা মামলাটির তদন্ত শেষ হয়নি। কয়রা থানার ওসি ফজলুর রহমান বলেন, পুলিশ হত্যা মামলাটি এখন তদন্ত করছে খুলনা সিআইডি। তদন্তের একই হাল সারাদেশে নিহত ১৫ পুলিশ হত্যা মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে। রংপুরের পীরগাছা থানার ওসি মকবুল হোসাইন বলেন, মোজাহার হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, মামলার তদন্তের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের উচিত পরিবারের সদস্য মনে করেই আন্তরিকতার সঙ্গে মামলার তদন্ত শেষ করা। মামলা থেকে 'বেনিফিট' বিষয়টি দেখলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। পুলিশ বাহিনীর স্বার্থেই দ্রুত এসব মামলার তদন্ত শেষ হওয়া উচিত।
স্বজনের কথা :পুলিশ হত্যার ঘটনায় সব মামলায় পুলিশই বাদী হয়েছেন। দীর্ঘদিন পার হলেও অনেক মামলার তদন্তে তেমন অগ্রগতি নেই। স্বজনরাও জানেন না, কবে হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হবে। পুলিশ কনস্টেবল মফিজুর শেখের ছেলে পারভেজ শেখ সমকালকে বলেন, মামলার তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলেও আমাদের কিছু অবগত করা হয় না। এ কারণে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকারের বাবা বিমল সরকার বলেন, মামলার ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই। সরকারই বাদী হয়েছে। কনস্টেবল ফেরদৌস খলিলের স্ত্রী হোসনেআরা বলেন, ঢাকা থেকে স্বামীর লাশ আনার দিন এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছি। আর কিছু পাইনি। মামলার ব্যাপারে পুলিশ জানে।
যারা নিহত :জামায়াত-শিবিরের সহিংসতায় নিহত ১৫ পুলিশ সদস্য হলেন_ এসআই শাহজাহান, নায়েক ফিরোজ খান, কনস্টেবল মো. বাবুল মিয়া, হযরত আলী, তোজাম্মেল হোসেন, খাজা নাজিম উদ্দিন, আবু তারেক, জিএম ওমর ফারুক ও মোজাহার আলী, ফেরদৌস খলিল, সিদ্ধার্থ সরকার, জাকারিয়া, আবু তারেক, কাজী জহুরুল হক ও আজিজুর রহমান।

No comments

Powered by Blogger.