'গঠনমূলক' বিরোধী দল হতে জাপা কি প্রস্তুত? by শেখ রোকন

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ভালো কি মন্দ_ জানুয়ারির ৫ তারিখে অন এয়ার চলচ্চিত্রের শেষে গিয়ে স্পষ্ট হবে। এখনকার স্টিল ফটোগ্রাফি হচ্ছে, নবম ও সপ্তম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল এবং পঞ্চম ও অষ্টম সংসদের সরকারি দল বিএনপি নির্বাচনী ট্রেন মিস করেছে এবং এই চার সংসদে তাদের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ যাত্রীস্বল্প ট্রেন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। উন্নয়ন সহযোগীদের পশ্চিমা অংশ শিকল টেনে ট্রেনটি থামানোর চেষ্টা করেছে বটে; লোকোমাস্টার বৃহৎ প্রতিবেশীর দোলানো সবুজ পতাকা আমলে নিয়ে স্টেশন ছেড়েছে। তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি লাগেজসহ স্টেশনে এসে দৃশ্যত দোটানায় পড়েছিল_ ট্রেনে উঠবে কি-না। শেষ মুহূর্তে এইচএম এরশাদ, রওশন এরশাদসহ পার্টি হাইকমান্ডের প্রায় সবাই উঠে পড়েছেন; জিএম কাদেরসহ বেশির ভাগ স্টেশনে রয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে নির্বাচিত ৩৩ জন সংসদ সদস্য হিসেবে এবং অন্তত তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। রওশন এরশাদ এখন দশম জাতীয় সংসদের আনুষ্ঠানিক 'বিরোধীদলীয় নেতা'। পার্টি চেয়ারম্যান 'প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত' হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা বা প্রথম আলো অনলাইনে (১৫ জানুয়ারি) প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে 'ধরা খাওয়া' নেতারা এখন এরশাদের মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায়।
রাজনীতির রেলপথে দাঁড়িয়ে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় সংসদে দুই দশক ধরে প্রধান বিরোধীদলীয় আসন পাল্টাপাল্টি করা বিএনপির শূন্যস্থান জাতীয় পার্টি কি পূরণ করতে পারবে? এক্ষেত্রে দুই দশকের অভ্যস্ততা যদি প্রথম বাধা হয়, দ্বিতীয় বাধা হচ্ছে জাতীয় পার্টির ইমেজ সংকট। বলে রাখা ভালো যে, গত দুই দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির 'সংকট' নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যত লেখালেখি বা আলোচনা হয়েছে; সম্ভাবনা নিয়ে তার এক আনাও হয়নি। ভোটের হিসাবে কম গুরুত্বপূর্ণ ইসলাম বা বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর ভূত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সিরিয়াসলি তর্ক-বিতর্ক হলেও জাতীয় পার্টি সেখানে অপাঙ্ক্তেয়ই রয়ে গেছে। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির দায়িত্ব যেন 'রাজনীতি' নয়, 'বিনোদন' জোগানো। জোটের রাজনীতিতে দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বারবার অবস্থান বদল যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, প্রতিটি নির্বাচনে বৈরী পরিস্থিতিতেও একাধিক আসনে তার বিপুল বিজয় গৌণই থেকে গেছে। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বিবেচনায় এইচএম এরশাদ যে অপর দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতার মতোই নিজের আসনে জনপ্রিয়তায় অপ্রতিরোধ্য_ সেটা বিবেচিত হয়নি। এরশাদের 'প্রতিশ্রুতি' ভঙ্গ বিষয়ক আলোচনা ও লেখালেখি দেখলে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে ধারণাহীন যে কেউ ভাবতে পারেন, এই দেশে আর সবাই বুঝি নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় জীবন দিয়ে দেন।
রাজনৈতিক অতীত যদি বিবেচ্য হয়, মনে হবে যেন একমাত্র জাতীয় পার্টিই সেনাশাসকের নেতৃত্বে গঠিত। অথচ বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক জন্ম একই আঁতুড় ঘরে, একই ধরনের শাসকের ঔরসে। আমাদের প্রথম এবং দ্বিতীয় সামরিক শাসক একই কায়দায় 'হ্যাঁ-না' ভোটের মাধ্যমে নিজের প্রতি দেশবাসীর 'আস্থা' যাচাই করেছিলেন। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছে সত্য; কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং এ বছর ৫ জানুয়ারি বিএনপি ও আওয়ামী লীগও কি একই ধরনের নির্বাচন করেনি? দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে ক্ষমতাসীন থাকা তিনটি দলই তথৈবচ! দল ভাঙা, দলে টানার রেকর্ডও সবার রয়েছে। জাতীয় পার্টির শাসনামলের নীতিনির্ধারকদের বর্তমান অবস্থান যদি রেকি করা যায়, দেখা যাবে তাদের সিংহভাগই এখন দলবদল করে 'গণতান্ত্রিক' হয়ে গেছেন। জাতীয় পার্টির শাসনামলের শেষ ঘণ্টাগুলোতেও যিনি টেলিভিশনে ভাষণ দিচ্ছিলেন এবং পরে গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে পালিয়ে বেঁচেছেন; এই সেদিন দেখা গেল তিনিই 'গণঅভ্যুত্থান' ঘটিয়ে 'স্বৈরাচার' পতনের হুমকি দিচ্ছেন! তিন প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে আন্তঃমিলের তালিকা সুদীর্ঘ করা সম্ভব। সংক্ষেপে বলা যায়, যে যে কারণ দেখিয়ে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব 'স্বৈরাচার' তকমা পেয়েছে; মাত্রাভেদে একই ধরনের নজির অপর দুই 'গণতান্ত্রিক' দলের ক্ষেত্রেও দেখানো যায়। বিশেষত বিএনপির সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত মুখচ্ছবি ছাড়া জাতীয় পার্টির জন্ম, গঠন প্রক্রিয়া, আদর্শ, চর্চার অমিল পাওয়া কঠিন। ফলে বিএনপি যদি নবম সংসদে ৩২ জন এমপি নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হতে পারে; ৩৩ জন নিয়ে জাতীয় পার্টি সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দোষ কী?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, টানা দুই দফা সামরিক শাসনের নিগড় ভেঙে ১৯৯০ সালে সূচিত সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রার প্রথম থেকেই 'গঠনমূলক বিরোধী দলে'র যে আকাঙ্ক্ষা নাগরিক সমাজ বারবার ব্যক্ত করে এসেছে, সেই ভূমিকায় জাতীয় পার্টির অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? বিরোধী দলের 'গঠনমূলক' ভূমিকাই-বা কী? সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডের মতো বিরোধী দল সরকারি দলের ভুল দেখিয়ে দেবে কিংবা 'ছায়া মন্ত্রিসভা' গঠন করে যেখানে যেখানে সরকারের দুর্বলতা, সেখানে সহযোগিতা করবে_ এমন প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। কিংবা প্রতিবেশী ভারতের মতো রাজনৈতিক ইস্যুতে যুযুধান থাকলেও বিরোধী দল জাতীয় ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়াবে_ সেই আশাও না হয় ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকল। কিন্তু 'সংসদকে শাসন ও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু' করার যে প্রত্যয় প্রত্যেকবার ক্ষমতায় গিয়ে আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল দিয়ে আসছিল, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তার বাস্তবায়নে সদিচ্ছা তো আমরা দেখতে চাইতেই পারি! দুর্ভাগ্যবশত, দেড় যুগের সামরিক শাসনামল পেরিয়ে যখন সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল, তখন থেকেই দেখা গেছে বিরোধী দল মানেই তাদের জন্য সাংসদীয় সত্য হচ্ছে, সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার শাশ্বত অনীহা। পঞ্চম সংসদে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ উপস্থিত ছিল ২৬৫ দিন। সপ্তম সংসদে বিরোধী দল বিএনপি উপস্থিত ছিল ২১৯ দিন। অষ্টম জাতীয় সংসদের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ উপস্থিত ছিল ১৫০ দিন। সদ্য গত নবম জাতীয় সংসদে দেখা গেছে ৪১৮ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মাত্র ৭৬ দিন উপস্থিত ছিল। দেখা যাচ্ছে, সংসদ অধিবেশনে আমরা যখন ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি প্রত্যাশা করেছি, তখন ক্রমান্বয়ে কমেছে!
এই চার সংসদে জাতীয় পার্টি কতদিন উপস্থিত ছিল সেই হিসাব পাওয়া দুরূহ। সংসদ 'বিট' কাভার করেন এমন অন্তত তিনজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছি; সুশাসন নিয়ে তৎপর জাতীয় পর্যায়ের নাগরিক সংগঠনের কর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছি। কারও কাছে উত্তর নেই। তবে সবাই বলেছেন যে, জাতীয় পার্টি চারটি সংসদেই প্রায় নিয়মিত উপস্থিত থেকেছে। অন্তত প্রধান বিরোধী দলের চেয়ে বেশি। নবম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সাকল্যে উপস্থিত ছিলেন ১০ দিন। রওশন এরশাদ ৯৪ দিন। প্রায় দশ গুণ!
জাতীয় পার্টির সংসদীয় উপস্থিতি হদিসের অভিজ্ঞতাও এই ধারণাকে শক্ত ভিত্তি দেয় যে, আমাদের সংবাদমাধ্যম, নাগরিক সংগঠন দুই প্রধান দলের বাইরে অন্যদের নিয়ে উৎসাহী নয়! এখন, যে প্রক্রিয়াতেই হোক, বিরোধী দল নির্বাচিত হওয়ার পর জাতীয় পার্টি কি আমাদের দুই দশক প্রাচীন আকাঙ্ক্ষা পূরণে আগ্রহী? জাতীয় পার্টির নেতারা ইতিমধ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন যে, সংসদে প্রথাগত বিরোধী দল হতে চান না তারা। এমনকি নিছক 'ছায়া' সরকার গঠন নয়, মূল সরকারেও তারা অংশ নিতে চান। ইতিমধ্যে নিয়েছেনও। একই দলের বিরোধীদলীয় আসনে বসা এবং মন্ত্রিসভায় অংশ নেওয়া অনেকের কাছে অভূতপূর্ব হলেও পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ দিচ্ছেন অনেকে। বাস্তবে এটা কতখানি সম্ভব, সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে।
এখনকার মতো বলা যায়, জাতীয় পার্টি ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দেখার বিষয়, দলটি তিন দশকের আলো-ছায়া কাটিয়ে লাইমলাইট পাওয়ার সুযোগের কতখানি সদ্ব্যবহার করতে পারে! এজন্য যদি আর কিছু না হোক সংসদের প্রত্যেক কার্যদিবসে উপস্থিত থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে রেকর্ড তৈরি করতে পারে। সংসদ কার্যক্রমে সোচ্চার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে সরকারের অংশ নেওয়ায় তৈরি হওয়া প্রশ্নও ফিকে করে ফেলতে পারে। যদিও নিরেট তথ্য-উপাত্ত নেই; বিরোধী দল হিসেবে রেটিংয়ে জাতীয় পার্টির অন্তত বিএনপির তুলনায় এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। আর দলটি যদি সত্যিকারের 'গঠনমূলক' বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়, কেবল ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে না, ভোটের রাজনীতিতেও দলটি সুবিধা পেতে পারে। দেশের বিপুল নাগরিক যেহেতু 'গঠনমূলক' রাজনীতি দেখতে চায় এবং প্রধান দুই দল ইতিমধ্যে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে; চাই কি একাদশ সংসদ তাদের জন্য সরকার গঠনের সুযোগও এনে দিতে পারে। বিচিত্র কী!
শেখ রোকন :সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.