মেহনতি মানুষের বন্ধু by বিমল বিশ্বাস

কমরেড অমল সেন ১৯১৪ সালের ১৯ জুলাই আউড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নড়াইলের আফরার জমিদার পরিবারের সন্তান। নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী 'অনুশীলন' গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত হন। দৌলতপুর বিএল কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় মার্কসবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন এবং গণিত শাস্ত্রে অনার্স পড়াকালীন নড়াইলে ফিরে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন মানবজীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হতে পারে মানব সমাজের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা তথা শ্রমজীবী মানুষের শোষণ মুক্তির লড়াইতে অংশগ্রহণ করা। আর সে কাজটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে তিনি মনে করতেন। তাই তিনি সারাজীবন নিজেকে এ সংগ্রামে নিয়োজিত রেখেছিলেন। কমরেড অমল সেন যে রাজনীতি ও সামাজিক পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সে তুলনায় আজকের পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের থেকে অত্যন্ত জটিল, কঠিন ও মানবিক মূল্যবোধের নতুন এক স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলনের বিভিন্ন স্রোতধারায় বুর্জোয়া মূল্যবোধের শিকারে পরিণত হওয়ার এক প্রচণ্ড সর্বনাশা ঝোঁক পরিলক্ষিত হচ্ছে, যার থেকে 'সব গেল গেল' এক ধরনের আর্তনাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য বিপ্লবী শ্রেণীসংগ্রামের কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য ধারা সৃষ্টির সচেতন কাজকে এগিয়ে নেওয়ার শর্টকাট কোনো পথ খোলা নেই। তাই সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কমরেড অমল সেনের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার কাজকে এগিয়ে নিতে হবে। বর্তমানে বুর্জোয়া ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো শ্রেণী গণসংগঠনও শ্রেণী-পেশার সংগ্রামকে বিভক্ত রেখে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ারগুলোকে প্রায় অকেজো করে ফেলেছে। সে কারণে শ্রেণী-পেশার সুনির্দিষ্ট দাবিতে ব্যাপক ঐক্যের ধারা সূচনা করা এক জরুরি কাজ। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে আজ যখন সাম্রাজ্যবাদী মদদে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী শক্তির উন্মত্ত তাণ্ডব লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেখানে শ্রেণী ও গণসংগ্রামের ধারায় ব্যাপক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিমূলে আঘাত হানতে হবে। শ্রমজীবী জনগণের ব্যাপক অংশ কখনও শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারায় শামিল হয় না। তাই জনগণের দৈনন্দিন জাতীয় ও স্থানীয় অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দাবির সংগ্রাম গড়ে তুলেই ব্যাপক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী শক্তি এক উন্মত্ত চেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদ ধ্যান-ধারণার দেশ ও সমাজে পরিণত করে তুলতে চাচ্ছে। এমতাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আন্তঃবিরোধ ভুলে গিয়ে সব অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য গড়ে তোলার কাজটি উপেক্ষা করার ক্ষমাহীন প্রবণতা শত্রুশক্তিকে আরও বেশি বেগবান করে তুলছে। কমরেড অমল সেন তার তত্ত্বগত লেখা ও প্রায়োগিক কাজে শত্রুকে পরাভূত করার জন্য ব্যাপক ঐক্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়ে তোলার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এমনকি তিনি তার লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন যে, শ্রেণীসংগ্রামের কাজকে উপেক্ষা করলে কমিউনিস্ট পার্টি বা গ্রুপ তার কমিউনিস্ট চরিত্র খুইয়ে ফেলবে। তাই কমরেড অমল সেনের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রয়োগজনিত অভিজ্ঞতা ও তত্ত্বগত শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরে আমরা শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লড়াইকে এগিয়ে নেওয়ার শপথ নিতে পারি। সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর লুটেরা ধনিকশ্রেণী রাষ্ট্র ও সমাজকে পাল্টে দিয়ে শ্রমজীবী জনগণের বিকল্প রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথকে দুরূহ থেকে দুরূহতর করে তুলেছে। তাই সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কমরেড অমল সেনের নির্দেশিত পথের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে মেহনতি গণমানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পারলেই কেবল এ দেশকে শোষণমুক্ত ও শ্রমজীবী মানুষের পক্ষের রাষ্ট্রে পরিণত করার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে।
বিমল বিশ্বাস : পলিটব্যুরো সদস্য বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

No comments

Powered by Blogger.