প্রকৃতি ও জীবনের অন্বেষক : প্রকৃতিকথা

পাস্কাল তার এক খেরো খাতায় লিখেছিলেন- প্রকৃতি হচ্ছে এক অসীম পরিমণ্ডল যার কেন্দ্র আছে সর্বত্রই, কিন্তু পরিধি নেই কোথাও। বিভিন্ন শতাব্দীতে প্রকৃতিপ্রেমী চিন্তকশ্রেণী এ রূপকল্পটিকে নানাভাবে ধরতে চেয়েছেন। জিওদার্নো ব্র“নো ৫৮৪ সালে এ রূপকটিকে আরেকটু ভিন্নার্থে উচ্চারণ করেন- ‘আমরা নিশ্চিত বলতে পারি যে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডই হচ্ছে সবকিছুর কেন্দ্র অথবা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র আছে সর্বত্রই এবং এর পরিধি নেই কোথাও। বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তক সের্গেই লুইস বোরহেস আজীবন ছুটেছেন এ রূপকার্থটি আবিষ্কার করতে। আর আমাদের রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির পরিধি নির্ণয়ের কথা বাঙালি পাঠকমাত্রই জানেন। তার সেই শিমুলগাছ নিয়ে বলাই গল্পটি মর্মস্পর্শী। গত অর্ধশতকজুড়ে পৃথিবীতে যে শিল্পায়নের বর্জ্য পৃথিবী এবং প্রকৃতিকে দম বন্ধাবস্থায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে তার হিসাব করা দুঃসাধ্য। কিন্তু বিবেকবান প্রকৃতি প্রেমী মানুষরা বারবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এ বিনাশ থামাও, কিন্তু থামেনি। আইএ ক্লাসের যখন ছাত্র তখন কবীর চৌধুরীর অনুবাদে বুলগেরিয়ার ছোট গল্প পড়েছিলাম- একটা গল্প ছিল ‘অরণ্যের আর্তনাদ’। গল্পের নায়ক বনরক্ষী এক সাচ্চা প্রকৃতিপ্রেমিক। রাতে সে বনখেকোদের উদ্দেশে সাবধান বাণী উচ্চারণ করত হেই বন কেট না। একদিন বনখাদকরা গুলি করে তাকে হত্যা করে। সেই বনরক্ষীর মতো বনরক্ষা করতে গিয়ে কত লোকের যে এখনও প্রাণ দিতে হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সম্প্রতি প্রকৃতিপ্রেমী মুকিত মজুমদার বাবু সম্পাদিত প্রকৃতিকথা এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ গ্রন্থ দুটি- আমাকে উপহার হিসেবে দিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর। মুকিত মজুমদার বাবু চ্যানেল আইতে প্রকৃতি ও জীবন নামে অনুষ্ঠান করেন- তিনি এ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তার সম্পাদিত প্রকৃতি কথায় জলবায়ুর পরিবর্তন এবং আমাদের দেশে তার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। ৩৬ জন প্রকৃতি চিন্তকের লেখা সংকলিত হয়েছে গ্রন্থে। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার একটি সামান্য দাবি- লেখাটি আমাদের নিয়ে যাবে কৈশোরে সেই প্রিয় নদীটির কাছে। লেখাটি একটা গানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে বারবার- আমার একটা নদী আছে জানাল নাত কেউ। দ্বিজেন শর্মার নদীটি পাহাড় এবং গাছ কাটার ফলে এখন মৃত প্রায়। আইনুন নিশাত পানি বিজ্ঞানী। তিনি নদীশাসন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চেয়েছেন- নদী শুধু পাড় ভাঙে না তলদেশ আরও গভীর করে। নদীশাসনের যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে তা না মেনে ভরাট করা- বাঁধ দেয়ার ফলে নদীর মৃত্যু হতে পারে। আলী ইমামের লেখালেখির অর্ধেকটাজুড়েই প্রকৃতি ও পাখি। তিনি এ ফ্যাকাসে ধূসর বৃক্ষহীন পৃথিবীর কথা বলতে গিয়ে বাংলা চলচিত্রের এক হৃদয়স্পর্শী গানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন- শোনো বন্ধু শোনো/ প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা/ ইটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায় দারুণ মর্ম ব্যথা/ এখানে আকাশ নেই/ এখানে বাতাস নেই/ এখানে আছে অন্ধগলির মুক্তির আকুলতা। এ গানটি এখন যে কোনো নগরবাসীর জন্য ভয়ংকরভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের প্রতিবেশ এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে তা যে কোনো মানুষও বুঝতে পারছে। বিপ্রদাস বড়–য়া বঙ্গোপসাগরের জীবনবৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলেছেন, তার লেখায় বঙ্গোপসাগরকে তিনি বলেছেন- সে রত্নাকর, শান্ত সুশ্রী, রুদ্র ভয়ংকর, শিক্ষকও প্রেয়সী- আমাদের শস্য ভাণ্ডার, রূপের ভাণ্ডার ইত্যাদি। লেখাটি গোলাম মোস্তফার ‘পদ্মা’ প্রবন্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই পদ্মা আজ মরা খালে রূপান্তরিত হতে চলেছে। আমরা যেখানে বাস করি এ ঢাকা মহানগরী তার দুর্দশার অন্ত নেই- কত উদ্ভিদ বৃক্ষরাজি ফুল প্রজাপতি পাখি আজ আর নেই- আছে ‘লোহার ঘোড়া’ অর্থাৎ যানবাহন। চিনুয়া আচেবে তার Things fall apart বিখ্যাত উপন্যাসে এ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কি উদ্যোগী- এ বৃক্ষ বিনাশের ক্ষতিপূরণ পুষিয়ে দিতে, তা আমরা জানি না। মোকারম হোসেন তার নিবন্ধে রাজধানীর এক লোমহর্ষক হত্যা চিত্র তুলে ধরেছেন। বিশ্ব বিখ্যাত মিসরের ফারাওদের সভ্যতার একটা স্মারক প্যাপিরাস গাছ ঢাকার বলধা গার্ডেন আছে- কতদিন থাকবে তা জানি না। প্রত্যেকের লেখায় এ সত্যই প্রতিভাত যে- আমরা অজ্ঞানতা অপ্রেম আর সীমাহীন লোভের বশবর্তী হায়- নিজ হাতে ধংস করছি প্রকৃতি। গ্রন্থের সম্পাদক সব শেষে নিবন্ধ দিয়েছেন মুকিত মজুমদার বাবু- জলবায়ুর পরিবর্তনে আমাদের মনে উন্নয়নশীল দেশগুলো যে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তার একটা চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন- ১৯৫০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত- শিল্পোন্নত দেশগুলোর কারণে পৃথিবী ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বেড়েছে ৭২ শতাংশ। মানব সৃষ্ট ক্ষতিকর প্রাণঘাতী এ সমস্যার দিকে তিনি সচেতন জনগোষ্টীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। লোক দেখানো নয় বরং তিনি মনে করেন প্রকৃতিকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়ে যাওয়াই এখন মানব জাতির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কিছুদিন পরপর আইলা সিডরসহ যে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের বিপর্যস্ত করছে তার কারণ প্রকৃতির প্রতি মানুষের বৈরিতা। বিশ্ব প্রতিষ্ঠান ম্যাপলক্রাফট মনে করে আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের ১৬টি দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শীর্ষে থাকবে- বাংলাদেশ তার একটি। আমরা কি এ সাবধান বাণীর তোয়াক্কা করি, সামনে যে এক বিনাশী শক্তি এগিয়ে আসছে তাকে প্রতিরোধ করতে হবে বৃক্ষ নদী আর পাখপাখালির সুরক্ষা দিয়ে। এ শংকা ও সাবধান বাণীর পাশাপাশি ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ’ মুশফিক আহমদ শামীম আহমেদ ও মুকিত মজুমদার বাবু সম্পাদিত গ্রন্থের ছবিতে প্রকৃতি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় ভালো লাগে। এখনও বাংলাদেশ এত পাখি, সৈকত আর বন্যপ্রাণীর সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। যে বিষধর গোখরা তার ও রুপালি ফনা মুগ্ধ করে- কি সবুজ সাপ- কি ভাগর চোখে চেয়ে আছে বিপন্নপ্রায় বানর জাতীয় প্রাণী উল্লুুক। প্রকৃতিতে বিস্ময়ের সীমা নেই সেই প্রকৃতি জীবনের নিবিড় জ্যামিতি যেন আমরা না ভুলি প্রকৃতি চিন্তক মুকিত মজুমদার বাবুর সেই কথাটিই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সেই কথাটিই আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন তার সম্পাদিত গ্রন্থে। আমরা প্রতীক্ষায় থাকব তার বৈচিত্র্যপূর্ণ আরও নতুন কাজের জন্য।
রেজাউদ্দিন স্টালিন

No comments

Powered by Blogger.