আমরা যেন দাবার ঘুঁটি না হই

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষে দেশ আবারও নীল হলো। কয়েকটি জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার হলো। তাদের ঘরবাড়ি পুড়ল, সম্পদ লুট হলো, নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে গৃহহীন হলেন অনেকেই। নির্বাচনকে উপলক্ষ করে পাবনা, যশোর, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হলো। আক্রমণকারীদের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি-আওয়ামী লীগ সবাই আছে। মানুষ দেখল, রাষ্ট্র ও তার বাহিনীগুলো কত নির্লিপ্ত থাকতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেছিলাম আমরা। এর শিকার হয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর সরকার পরিচালনা করলেও অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে পারেনি। এবারও পারবে কি না সন্দেহ আছে। কেননা, আওয়ামী লীগ ক্রমেই ‘মুসলমানদের দল’ হয়ে উঠছে। ‘হিন্দুদের জমি, দোকান, ব্যবসার প্রতি দলমত-নির্বিশেষে চোখ পড়ে সবারই। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর লোকেরা সহিংসতায় জড়িত বলে পত্রিকায় খবর ও ছবি ছাপা হয়েছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ বুলি বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছু নয়। এ দেশে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা। এখানেই ছিল পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির সঙ্গে প্রধান পার্থক্য।
তবে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে দ্বিধাহীন ও সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল না। এখানে ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর বেতার ও টেলিভিশনে দেওয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচন-পূর্ব নীতিনির্ধারণী ভাষণের উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘ছয় দফা বা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচি ইসলামকে বিপন্ন করে তুলেছে বলে যে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে, সে মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য আমি শেষবারের মতো আহ্বান জানাচ্ছি। অঞ্চলে অঞ্চলে এবং মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তাপ্রত্যাশী কোনো কিছুই ইসলামের পরিপন্থী হতে পারে না। আমরা এ শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ যে কোরআন-সুন্নাহ্র নির্দেশিত ইসলামি নীতির পরিপন্থী কোনো আইন এ দেশে পাস হতে বা চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে না।’ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ব্যবহার করা হয় বাহাত্তরের সংবিধানের প্রস্তাবনায়। কোনো একটি শব্দের উপর্যুপরি ব্যবহারে তার অন্তর্নিহিত আদর্শ যে প্রতিষ্ঠিত হয় না, তার বাস্তব প্রমাণ হলো, আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ সালে। এই যুদ্ধ শুধু দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের ছিল না, এই যুদ্ধে ভারত জড়িয়ে পড়েছিল। জড়িয়ে পড়েছিল অন্যান্য পরাশক্তিও, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। এটা সত্য যে পাকিস্তানের মাঠে পুরোনো হিসাব চুকিয়ে ফেলার একটা সুযোগ খুঁজছিল ভারত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সেই সুযোগটি এনে দেয়। ভারত জড়িয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি সচরাচর করে থাকে, অর্থাৎ ‘ভারত পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি করেছে,’ আমি তার সঙ্গে একমত নই।
এ প্রসঙ্গে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭৩ সালের জুনে অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেসে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মদদে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে তার প্রভাববলয়ে বাংলাদেশ নামে একটা তাঁবেদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।’ চীন তার বৈশ্বিক রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে মনে করত প্রধান শত্রু এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যা করত, চীন তারই বিরোধিতা করত। আমাদের স্মরণ আছে, মার্কিন মদদে চিলিতে যখন জেনারেল পিনোশের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলো এবং নির্বাচিত কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে নিহত হলেন, চীন তাৎক্ষণিকভাবেই পিনোশের অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিয়েছিল। একই কাজ চীন করেছিল ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের সময় পতিত রেজা শাহকে সমর্থন দিয়ে। চীন তখন সর্বত্র রুশ জুজু দেখত। চীন যেটা করেছে তার ‘জাতীয় স্বার্থে’। বাংলাদেশে বসে আমরা সে রকমটি কেন ভাবব? আমার দেশ তো চীন নয়, বাংলাদেশ। আমাকে দেখতে হবে আমার জাতীয় স্বার্থ। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল। এটা ধ্রুব সত্য। ভারত তার শত্রু পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চেয়েছিল। এটাও সত্য। দুটো ঘটনা একই সঙ্গে ঘটেছিল। দুটো লক্ষ্যই অর্জিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আসলে কি তাই? ভারত প্রসঙ্গে আসা যাক। ভারত কী চেয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তিনটি লক্ষ্য সামনে রেখে।
১. পাকিস্তান দুর্বল হবে এবং ভারতকে আক্রমণ করার শক্তি আর তার থাকবে না।
২. পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।
৩. বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকশিত হতে এবং ‘হিন্দু’ সম্প্রদায়ের সদস্যরা ভিটামাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আর যাবেন না। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে এই তিনটি অনুমানই প্রায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান দুর্বল হয়নি। তার হাতে আছে পারমাণবিক বোমা। কয়েক বছর আগে কারগিলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের তুমুল যুদ্ধ হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তান এখনো পরস্পরের শত্রু। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর থেকেই চীনারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থাকে। চীন উত্তর-পূর্ব ভারতের একটা বিশাল অংশকে নিজের বলে দাবি করে। সে জন্য চীনের এ ধরনের কাজের একটা যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু চীন যে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সেয়ানা, সেটা বোঝা যায় তার কৌশল থেকে। চীন এ জন্য বেছে নিয়েছিল পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড। চীন তার নিজের মাটিতে কোনো ‘জঙ্গি’ দলকে আশ্রয় কিংবা প্রশিক্ষণ দেয় বলে শুনিনি। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহূত হওয়ায় ভারত যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর আপাতত এটা বন্ধ হয়েছে বলে মনে করা হয়। সে কারণেই ভারত শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলকে ‘নির্ভরযোগ্য’ মনে করে এবং যেকোনো মূল্যে এই দলকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায়। এর ফলে এই অঞ্চলের রাজনীতিতে যথেষ্ট উত্তাপ তৈরি হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। ২০১৩-১৪ সালে আমরা একই নাটকের পুনরাবৃত্তি দেখছি। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে পিছু হটতে হয়েছিল। কেননা, স্বাধীনতার প্রশ্নে এ দেশের মানুষ ছিল ঐক্যবদ্ধ। বর্তমান সময়টি এ রকম নয়। জাতি আজ বিভক্ত। বহিঃশক্তির এই দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তৃতীয় অনুমানটি, অর্থাৎ বাংলাদেশে সেক্যুলার রাজনীতি বিকশিত হবে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আর ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে হবে না, এটাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরাও এ দেশে নিরাপদ বোধ করে না। নীরব অভিবাসন প্রক্রিয়া চলছে একই রকমভাবে। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা কানাডা-অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছেন। দরিদ্র মানুষের গন্তব্য হলো ভারত। যে প্রত্যয় ও আকাঙ্ক্ষা থেকে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, আজ তা অনেকটাই নির্বাসিত।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন-প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। একসময় মনে হতো, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় তার মিত্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে অন্যান্য দেশের ওপর ছড়ি ঘোরাবে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সমীকরণ বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। সমীকরণটি কার্যকর হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক কৌশলের কারণে অনেকগুলো অপশন খোলা রাখতে চাচ্ছে। বিএনপি এ রকম একটি অপশন। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। বিএনপির ব্যাপারে ভারতের যথেষ্ট উদ্বেগ আছে। নির্বাচনের কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং খোলামেলাভাবেই ভারতের আশঙ্কা এবং পছন্দ-অপছন্দের কথা জানিয়ে গেছেন। একাত্তরে ভারতের যুদ্ধ অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল। সুজাতা সিংয়ের বক্তব্য এবং পরবর্তী কার্যক্রম দেখে মনে হয়, ভারত এবার তার অসমাপ্ত যুদ্ধের একটা শেষ মীমাংসা করতে চাইছে। আমরা চাই বা না চাই, আমরা বড় দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি। আমাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে গণতন্ত্রায়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল আমাদেরই ঠিক করতে হবে। অর্থাৎ ভারত তার জাতীয় স্বার্থে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক স্বার্থে কৌশল ঠিক করবে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে, আমরা যেন কারও দাবার ঘুঁটি হয়ে না পড়ি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমাদের পথভ্রষ্ট করে দিচ্ছে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.