নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে রাস্তায় নেমেছে কর্মজীবী মানুষ

রাজধানীর চিত্র
টানা সহিংস অবরোধ ও হরতালে নাভিশ্বাস উঠেছিল সাধারণ মানুষের। নির্ভয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার উপায় ছিল না। সব সময় তাড়া করে ফিরছিল অজানা আতঙ্ক। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা দীর্ঘ প্রায় দুই মাসের স্বল্প বিরতির টানা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কর্মজীবী মানুষ। দমবন্ধ পরিবেশ কাটিয়ে কর্মমুখর হয়ে ওঠে রাজধানী। নগরবাসীর মধ্যে এক ধরনের স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। পুরোমাত্রায় কর্মচঞ্চল হয়ে পড়েছে রাজধানী। রাজপথের চিরচেনা যানজট আবারও ফিরে এসেছে। অফিস-আদালত, বিপণিবিতান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সর্বত্রই কর্মব্যস্ততা। অভ্যন্তরীণ রুটের বাস চলাচল স্বাভাবিক। দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ড আর রেলস্টেশনে যাত্রীদের ভিড়। দিনে মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও সদরঘাট নৌ টার্মিনালে যাত্রী আর ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকে কান পাতা দায়। হরতাল-অবরোধের মতো রাস্তায় নামলেই পেট্রোল বোমা ও ককটেলবাজির আতঙ্ক আর নেই। কেটে গেছে জনমানুষের যতসব দুর্ভাবনা। নির্ভয়, শান্তি ও স্বস্তির জীবনযাপন শুরু করেছেন রাজধানীবাসী।
গতকাল সোমবার সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কর্মব্যস্ত মানুষের নিত্য জীবনযাপন। ফার্মগেট, বাংলামটর, শাহবাগ, গুলিস্তান, মতিঝিল, ধানমণ্ডিসহ প্রায় সব এলাকায় যানবাহন ও মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। যানজটের দুর্ভোগ লেগে ছিল পুরানা পল্টন, মালিবাগ ও মৌচাক মোড়, রামপুরা, ধানমণ্ডি ১৫ নম্বর, জিগাতলা, মিরপুর রোড, কলাবাগান, নীলক্ষেত, শাহবাগ ও ফার্মগেট এলাকায়। কোর্টকাচারি, ইংলিশ রোড, জিপিও মোড় আর গুলিস্তান এলাকায় দিনভর দীর্ঘ যানজট লেগে ছিল। মাওয়া, কেরানীগঞ্জ, দোহার ও নবাবগঞ্জগামী বাসগুলোকে দীর্ঘ সময় বাবুবাজার ব্রিজের গোড়ায় যানজটে আটকা থাকতে দেখা যায়।
দিনভর ঘুরে দেখা গেছে, অনেক দিন পর রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। তাই কোনো আতঙ্ক না থাকায় বেরিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সরকারি কর্মদিবস হওয়ায় নানা কাজে ঘর থেকে সবাই বের হয়েছে। ফলে প্রতিদিনের তুলনায় রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতি বেশি। রাস্তায় ভরপুর যানবাহন। মাকের্টগুলোর সামনেও মানুষের বেশ জটলা, ভেতরেও ভিড়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কথা হয় ব্যবসায়ী ওয়াসিমুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'মানুষের মনে
স্বস্তি ফিরে আসছে। আমরা সাধারণ মানুষ মারামারি-কাটাকাটি চাই না। কোনো অপরাধ না করেও নিরীহ মানুষকে আতঙ্কের জীবনযাপন করতে হয়। এটা কি মেনে নেওয়ার মতো?' তিনি আশা প্রকাশ করেন, আর যেন ককটেল, পেট্রোল বোমা, দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুন কোনো সাধারণ মানুষের কপাল না পোড়ায়।
একই স্থানে দাঁড়িয়ে বাসযাত্রী নন্দিতা দাশগুপ্ত বলেন, 'হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেই সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে থাকি। যেমন আজ পাঠিয়েছি। তবে হরতালে ক্লাস হলেও আতঙ্কের কারণে স্কুলে পাঠাই না।' হাইকোর্টের মোড়ে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'গরিব মাইনষের কোনো বেইল আছে? হরতাল হোক আর অবরোধ, আমগো কাজ আমগোই করতে অইব। নয় পেডের ভাত অইব না।' তিনি বলেন, 'মনে তো চায় না খুন- খারাবির মধ্যে বাসা হইতে বের হই। কী করব? বের না অইলে তো পোলা-মাইয়া না খাইয়্যা মরবে।'
গত কয়েক দিনের (রোববার বাদে) মতোই সোমবারও সকাল থেকে দূরপাল্লার গাড়িগুলো ছেড়ে গেছে রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে। প্রতিটি কাউন্টারে ছিল গ্রাম থেকে ফেরা মানুষের ভিড়। আবার রাজধানীতে নানা কাজে আসা অবরুদ্ধ মানুষও স্বস্তির স্বাদ নিতে গ্রামের দিকে ছুটে চলেছে। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে ঈগল পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার ফারুক হোসেন সমকালকে বলেন, সকাল থেকে যাত্রীর চাপ ভালোই। খুলনা-যশোর রুটের এ কে ট্রাভেলসের যাত্রী সোনা মিয়া বলেন, টিকিট পর্যাপ্ত থাকলেও ভালো সিট পেতে ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। কারণ যাত্রীসংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকায় সবাই দূরের যাত্রায় নিরাপদ বোধ করছে। এ ছাড়া নতুন করে আবার কখন হরতাল বা অবরোধ ঘোষণা করা হয়, সেই শঙ্কাও অনেকের হৃদয়ে ভর করেছে।
বরিশালগামী সাকুরা পরিবহনের যাত্রী সুজন হাওলাদার বলেন, তিনি শনিবার ঢাকায় এসেছিলেন। রোববার দূরপাল্লার গাড়ি না ছাড়ায় যেতে পারছিলেন না। তাই সোমবার ফিরে যাচ্ছেন।
ঢাকা-পাটুরিয়াগামী আর আর পরিবহনের হেলপার জালাল উদ্দিন জানান, গতকাল ভোর থেকেই দূরপাল্লার যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। সকালে কুয়াশা থাকায় এবং গাবতলী থেকে একযোগে দূরপাল্লার বহু গাড়ি ছাড়ায় মহাসড়ক এবং দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটের উভয় পাড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।
কমলাপুর থেকে গতকাল নির্ধারিত সব ট্রেন ছেড়ে গেছে। বিকেল ৩টায় কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার খায়রুল বশীর জানান, সকাল থেকে আটটি ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গেছে। এসেছে ৫টি। কমলাপুরে যাত্রীদের চাপ মোটামুটি লক্ষ্য করা গেছে।
মিরপুর-গুলিস্তানগামী ১ নম্বর বাসের হেলপার ফরিদ বলেন, 'অবরোধ আর হরতাল নাই বইল্যা শান্তি লাগতাছে। হরকালকারী গো পরথম টার্গেট হইল যাত্রীবাহী বাস। সুযোগ পাইলেই তারা আমগো ওপর হামলা করে। তাই সব সময় আতঙ্কের মাঝে গাড়িতে ডিউটি করতে হয়। আইজক্যা সেই ভয় নাই।'
অবরোধ মুক্তির আনন্দে রাজধানীর মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। নারীদের অনেকে বেশ কিছুদিন আতঙ্কের কারণে বাসা থেকে বের হয়ে মার্কেটে যাননি। তাই এ সুযোগে মার্কেটে গিয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরেছেন।
অন্যদিকে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি। অনেকে আবার কয়েক দিনের বাজার একবারে কিনে নিয়েছেন। এমনি একজন গৃহিণী আফসানা বৃষ্টির সঙ্গে কারওয়ান বাজারে কথা হয় সমকালের। তিনি বলেন, 'হরতাল-অবরোধের কারণে বাজারে খুব একটা আসা হয় না। আমার সাহেব চট্টগ্রামে চাকরি করেন। তাই আমি নিজেই বাজার করি। আজ পুরো সপ্তাহের বাজার করে নিলাম।'
তেজগাঁওয়ের ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'অন্যান্য দিনের চেয়ে সবজি বহনকারী ট্রাক কারওয়ান বাজারে আজ ভোরে বেশি এসেছে। অনেকে আবার সাপ্তাহিক বাজার করেছেন। সরকারি অফিস খোলা থাকায় পুরো কারওয়ান বাজার, ফার্মগেটে সকাল থেকে গাড়ির চাপ রয়েছে।'
ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে ফার্মগেটের বিভিন্ন কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকায় এদিন সেগুলোকেও সচল দেখা গেছে। সকালে দেখা গেছে, বইয়ের ব্যাগ ঘাড়ে করে শিক্ষার্থীদের দৌড়ানোর চমৎকার দৃশ্য।

No comments

Powered by Blogger.