ক্ষমতার লড়াইয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি
ক্ষমতার লড়াইয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি |
প্রায় তিন সপ্তাহ দেশে কাটানোর পর গত সপ্তাহে যখন আমরা অবরুদ্ধ ঢাকা ছাড়ি, তখনো অবরোধ এতটা আতঙ্কজনক রূপ নেয়নি। সেটা ছিল অবরোধের দ্বিতীয় দিন। তবে প্রথম দিনেই আটজনের প্রাণহানির খবর ছিল সেদিনের সংবাদ শিরোনাম। আগুনে বোমায় অগ্নিদগ্ধ খেটে খাওয়া মানুষের যন্ত্রণাকাতর চেহারা আর ততোধিক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত স্বজনদের আহাজারির বর্ণনায় সেদিনের পত্রিকার পাতাগুলো ছিল ভরা। ওই সব করুণ কাহিনি একবারে পড়ে শেষ করা যায় না। বারবার থামতে হয়। নিজের মনের মধ্যে এক অজানা শঙ্কা বারবার উঁকি দেয়। ওই পরিণতি তো আমারও হতে পারত? যে রাজনীতির সঙ্গে এসব খেটে খাওয়া মানুষের সম্পর্ক পাঁচ বছরে শুধু এক দিন, ভোটের দিনের, সেই রাজনীতির লড়াইয়ের অসহায় শিকার এঁরা। এঁদের সংখ্যা এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। একুশ শতকের প্রথম দশকে আমরা প্রথম শুনতে পাই ‘কোলাটরাল ড্যামেজ’ কথাগুলো। যুদ্ধবাজ বুশ ও ব্লেয়ার জুটি যখন ইরাকে হামলা চালান, তখন হতাহত নিরীহ ইরাকিদের বর্ণনা করতে প্রথম ব্যবহূত হয় এই কোলাটরাল ড্যামেজ (অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি) শব্দমালা। বাংলাদেশে হাসিনা-খালেদার ক্ষমতার লড়াইয়ে নিহত ব্যক্তিরাও কি সেই একই ধরনের কোলাটরাল ড্যামেজের নিরীহ শিকার নয়?
লড়াইটা এখানে সামরিক না হলেও, ক্ষমতার দ্বন্দ্বটা একই রকম। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও পাশ্চাত্যের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ভাষায় কোলাটরাল ড্যামেজের সংজ্ঞা হচ্ছে, যুদ্ধকালে সামরিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার সময় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটে যাওয়া বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করবে, তাতে অংশ নেওয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবে এবং তার মাধ্যমে জনসমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করবে—সেটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দলীয় সমর্থকদের কেউ হতাহত হলে দলীয় নেতা-নেত্রীরা তাঁদের চিকিৎসা ও ক্ষেত্রবিশেষে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বও নিয়ে থাকেন। বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। দলের কর্মসূচি পালনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত দলীয় কর্মী-সমর্থকদের প্রতি এই দায়িত্ব পালন অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু দলীয় কর্মসূচির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দলের বাইরের মানুষের ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের সেই দায়িত্ববোধ একেবারেই দেখা যায় না। এই দায়িত্বহীনতার অবসান প্রয়োজন। প্রতিটি দলকে তার রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। না হলে যে কর্মসূচিতে জীবনহানির ঝুঁকি আছে,
সে ধরনের কার্যক্রম বাদ দিতে হবে। এটি যে শুধু বর্তমান বিরোধী দলের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, সব দলের জন্যই এটা একটা নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার অসহায় নাগরিকদের ক্ষতিপূরণ দাবির কথা কেউ বলেন না। অথচ, তাঁদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসার দায় তাঁদের নয়, রাজনীতিকদের। এঁদের পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের হলেও, সরকার তাঁদের নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করবে, সেই আশঙ্কা প্রবল। সুতরাং, এ ক্ষেত্রেও নাগরিক উদ্যোগ প্রয়োজন। আশা করি, রানা প্লাজায় হতাহতদের সহায়তায় যেসব নাগরিক গোষ্ঠী উদ্যোগী হয়েছিল, তারা এ ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়কারী সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় দেড় যুগ আগে। তাঁর বাসার ওপর তলাতেই ছিল বিবিসির অফিস। অ্যাসিডে আক্রান্ত মেয়েদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য তাঁর যে অক্লান্ত পরিশ্রম, সেই সূত্রেই তাঁর কাজের সঙ্গে আমার পরিচয়। সেদিন টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বোমার শিকার রোগীদের দুর্ভোগের নানা কাহিনি বলছিলেন।
তাঁর বর্ণনায় উঠে এল গণপরিবহনে আমাদের নিজেদের ডেকে আনা বিপদের কথা। ছিনতাই ও ডাকাতির উপদ্রব থেকে বাঁচতে কর্তৃপক্ষের পরামর্শে ঢাকার সব সিএনজিচালিত অটোরিকশায় এখন নিরাপত্তামূলক লোহার খাঁচা লাগানো হয়েছে। অনেক বাসে, বিশেষ করে দূরপাল্লার বাসে লোহার দরজা বসেছে চালক ও যাত্রীদের মাঝখানে। আর, নগরের মধ্যে চলাচলকারী বাসগুলোর অনেকটিই চলাচল করে দরজা বন্ধ করে। ফলে এগুলোর ভেতরে পেট্রলবোমা বা গান পাউডার ছড়ানোর পর আগুন মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এসব যানবাহন থেকে লাফিয়ে পড়ার কিংবা বেরোনোর কোনো পথ থাকে না। পরিবহনমালিক ও কর্তৃপক্ষের উচিত হবে বিষয়টি ভেবে দেখা। হরতাল-অবরোধ, ককটেলবাজি কিংবা বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশে নতুন নয় এবং বড় দুই দলের কেউই এই দোষ থেকে মুক্ত নন। তবে, এই ভয়াবহ নৃশংসতা এখন অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষ পোড়ানোর রাজনীতির জন্য তাঁর প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়াকে দায়ী করে বক্তৃতা করার সময় দিব্যি ভুলে থাকেন যে তাঁর মন্ত্রিসভার একজন প্রতিমন্ত্রী যুবনেতার বিরুদ্ধে রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে বিআরটিসি বাসে আগুন দিয়ে ডজন খানেক যাত্রীকে অগ্নিদগ্ধ করার মামলা ছিল, যেটি তাঁর সরকার ক্ষমতার জোরে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
আদালতে তাঁর কোনো বিচার হয়নি। তিনি নির্দোষ হলে এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি দলটির আস্থা থাকলে প্রশাসনিক আদেশে মামলা তুলে নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো এই যে গণতান্ত্রিক শাসনামলে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে উভয় পক্ষই একে অন্যের চেয়ে অধিকতর অনিষ্টসাধনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ফলে তৈরি হচ্ছে নৃশংসতার নতুন নতুন রেকর্ড। যানবাহনে হামলা, আগুনে বোমার ব্যবহার ও রেললাইন উপড়ে ফেলার মতো নাশকতার জন্য কারা দায়ী, সেই প্রশ্নে বিতর্কের শেষ নেই। সরকারের কেউ কেউ বলছেন, এগুলোর জন্য দায়ী বিরোধী দল, আবার কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি এগুলোর ঠিকাদারি দিয়েছে জামায়াত-শিবিরকে। অন্যদিকে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, এসব হামলার সঙ্গে বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকেরা জড়িত নন, বরং সরকারের চর কিংবা ভাড়াটে দুষ্কৃতকারীরা বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানোর জন্য এসব হামলা চালাচ্ছে। বিরোধী নেতাদের এই দাবি সত্য হলেও, এসব প্রাণহানির দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না। রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়ার সময় তাঁদের ভাবা উচিত, সেই কর্মসূচি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে কি না। যে কর্মসূচির দায়িত্ব নিতে তাঁরা অক্ষম, সেই কর্মসূচি দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চল বা রীতি বন্ধ হওয়া দরকার। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের এসব দাবি-পাল্টাদাবির কোনটা সত্যি,
সেই বিতর্কের হয়তো ইতি ঘটত যদি পুলিশ একটি হামলারও সুরাহা করতে পারত। কিন্তু বিস্ময়করভাবে তারা হুকুমের আসামি হিসেবে বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ড চাওয়ায় যতটা তৎপর ও সফল, আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করায় ততটাই নিষ্ক্রিয় বা ব্যর্থ। এর পাশাপাশি বিতর্কিত নির্বাচনকালীন সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীর মন্তব্য ‘সমঝোতা হলে বিরোধী নেতারা কেউ কারাগারে থাকবেন না’ (ইত্তেফাক, ৩০ নভেম্বর ২০১৩) ভিন্ন ধরনের সন্দেহের জন্ম দেয়। যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যে ইঙ্গিত মেলে যে সরকার তার শর্ত মানতে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী রাজনীতিকদের আটক করেছে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের আগুনে পোড়া কিংবা প্রাণহানির ঘটনাগুলোয় সরকারের কিছুই আসে যায় না, বরং তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিরোধীদের বশে আনা। ক্ষমতার রাজনীতিতে জীবনের প্রতি অবজ্ঞার এই অসুস্থ ধারার শেষ কোথায়?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
No comments