নাগরিক মন্তব্য: গীতা সেন: শান্তিপ্রিয় জনতার মুখপাত্র
১৮ দলের অবরোধ চলাকালে গত ২৮ নভেম্বর
সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা হয়। এতে মেয়েসহ
দগ্ধ হন গীতা সেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন
গীতাসহ অন্যদের দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ ডিসেম্বর সেখানে যান।
প্রধানমন্ত্রীকে
সামনে পেয়ে গীতা আকুতি আর ক্ষোভ নিয়ে কিছু কথা বলেন। সেই কথোপকথনের
ভিত্তিতে পরদিন ২ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোয় ‘আমরা অসুস্থ সরকার চাই না’
শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। খবরটি সাধারণ পাঠকের মনে নাড়া দেয়। ওই
দিন এটি ছিল প্রথম আলো ডটকমে সবচেয়ে পঠিত ও আলোচিত সংবাদ। পাঠকের করা
মন্তব্যের উল্লেখযোগ্য এখানে তুলে ধরা হলো:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাঠক প্রথম মন্তব্যটি করেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি সাধারণত কাঁদি না। তবে এবার না কেঁদে থাকতে পারিনি। খবরটি পড়ার পর আমার চোখ কান্নায় ভিজে গেছে।’ গীতা সেনের উদ্দেশে জে আই সোহেল বলেন, ‘আপনারা, আমরা ফুটবল। যার কাছেই যাবেন সে-ই লাথি দেবে। কোনো সাইডেই আমরা নিরাপদ না।’ সাহসী গীতাকে সালাম জানিয়েছেন হাসনাইন।
হাছান লিখেছেন, ‘গীতা দিদি হলেন শান্তিপ্রিয় জনতার মুখপাত্র।’ শেখ ইমতিয়াজ মাহমুদের কথা, ‘আমরা অসহায়, সাধারণ মানুষের কান্না কেউ শুনতে পায় না। আমরা গরিব দেশের নাগরিক, তাই আমাদের কোনো মানবাধিকার নেই।’ তারিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘শুধু ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না আপনাকে। আপনি অসাধারণ কথা বলেছেন দুজনকে।’ গীতাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তন্ময় রায় চৌধুরী, রেজাউল, রবিনসহ আরও অনেকেই।
নাসের আহমেদের বক্তব্য, ‘গীতা সেনকে আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে শত-সহস্র নমস্কার। তিনি যেন দেশের মানুষের মনের কথাটাই বলেছেন। তাঁর যে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, এ অবস্থাতেও তিনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সামনে তাঁর মুখের ওপর কথাগুলো বলতে পেরেছেন। যে মুহূর্তে তাঁর সরকারি সাহায্য জরুরি, সেই মুহূর্তে তিনি খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হওয়ার সাহস দেখিয়েছেন কেবল দেশের মানুষের মনের কথাগুলোর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী উদারভাবে বিষয়টি দেখবেন এবং তাঁর এবং অন্যদের প্রতি সরকারি সাহায্য অব্যাহত রাখবেন।’
প্রধানমন্ত্রীকে সামনে পেয়ে জনগণের মনের কথাগুলো বলায় গীতা সেনের প্রশংসা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাঠক বলেন, ‘গীতা সেন আপা, স্যালুট...। বাংলার সাধারণ মানুষের মনের কথা আজ আপনি শুনিয়ে দিলেন।’ মাহফুজা বুলবুল বলেন, ‘আমরা ভালো সরকার চাই...আমরা অসুস্থ সরকার চাই না। ১৬ কোটি মানুষের এই চাওয়া যা দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ বলতে পারছে না; তা নির্দ্বিধায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সামনে বলে ফেললেন সাধারণ নাগরিক গীতা। শাবাশ গীতা। ১৬ কোটি মানুষের অব্যক্ত কথাটা বলার জন্য!’ মো. মাহাদী হাসান লিখেছেন, ‘গীতা সেন যা বলেছেন, তা আমাদের দেশের সব সাধারণ মানুষের কথা। হাজার সালাম তাঁর এই সাহসী ভূমিকার জন্য। আমরা কাপুরুষের দল চাটুকারিতা, ভণ্ডামি, নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু করি না। আর নয়। আমরা পুড়ে মরতে চাই না। আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা বাঁচতে চাই। আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’
গীতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মো. মাসুদ রানা বলেছেন, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। প্রধানমন্ত্রীকে উপযুক্ত কিছু কথা বলার জন্য; যা আমরা বলার সুযোগ পাই না বা যা বললেও উনি শুনতে পান না। আপনি শোনাতে পেরেছেন। ওনার মাথায় কিছু থাকলে বুঝতে পারবেন।’ নির্ভীক চৌধুরী বলেছেন, ‘যে কথাটি দেশের কেউ বলতে সাহস পায় না, তিনি সেই কথাটি নির্ভীক চিত্তে নির্দ্বিধায় বলেছেন, যখন তাঁর হূদয় ও দেহ আগুনে ঝলসে গেছে।...আমরাও চিৎকার করে বলি, অসুস্থ সরকার আমরাও চাই না।’
এ ঘটনার জন্য বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে দায়ী করে বিপুল নামে এক পাঠকের মন্তব্য, ‘এই দগ্ধ মানুষগুলোর যন্ত্রণা আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বুঝলে টাকাপয়সা খরচ করে মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করার জন্য বারবার অবরোধের ডাক দিতেন না।’ এ এন এম হাবিব বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী আর মৌলবাদীদের ব্যাপারে নিজের অবস্থান পরিষ্কার না করলে সচেতন ছাত্রদের পাশে পাওয়ার কোনো সুযোগ বিএনপির নেই।’ এ এন এম হাবিবের মন্তব্য, ‘যার সন্তান একজন সিঙ্গাপুরে, আরেকজন লন্ডনে; তাঁর জন্য দেশের মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেওয়া কত সহজ, আমরা তা দেখলাম। যত নিষ্ঠুরই হওয়া লাগুক, ক্ষমতা আমার চাই।’
বিএনপির কোনো নেতা হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধদের দেখতে না যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সাকিব খান বলেন, ‘বিএনপির নেতারা জানেন কারা বাসে বোমা মেরে আগুন দিয়েছে। তাই বিএনপির কোনো নেতা এখনো হাসপাতালে এই আগুনে পোড়া আহত মানুষগুলোকে দেখতে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি।’ মনিরুজ্জামান বলেছেন, বার্ন ইউনিটে অগ্নিদগ্ধদের দেখতে গেলে সাধারণ মানুষ যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটা খালেদা জিয়া ভালো করেই জানেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাঠক বলেছেন, ‘বিরোধীদলীয় নেতারও হাসপাতালে যাওয়া উচিত। না হলে বুঝব, আপনি সাধারণ মানুষের পাশে নেই।’ চয়ন কুমার সরকারের মন্তব্য, ‘তালেবানদের মতো গোপন ভিডিওবার্তা পাঠাবেন, হরতাল দিলাম পুড়িয়ে মারো। এটা সংগ্রাম হতে পারে না, আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। এর জন্য সরকার যা যা করবে, তাতেই আমাদের সমর্থন থাকবে।’
আবার বার্ন ইউনিটে আহত ব্যক্তিদের দেখতে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে রুসলান মুমতাজ লিখেছেন, ‘আমি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেব যে উনি ধৈর্য ধরে বার্ন ইউনিটে অগ্নিদগ্ধদের যত অভিযোগ আছে তা শুনেছেন। অন্তত তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিরোধী দলের নেত্রী তো এখন পর্যন্ত দুঃখও প্রকাশ করেননি। বার্ন ইউনিটে যাওয়া তো দূরের কথা। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূলে থাকুক না কেন, তাঁর মোকাবিলা করার মতো সৎ সাহস অন্তত শেখ হাসিনার আছে। উনি ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকেন না। পিলখানায় এত বড় ঘটনার পরও উনি নির্ভয়ে একা সেনাকুঞ্জে কয়েক শ সেনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ধৈর্য ধরে সেনাদের সব অভিযোগ শুনেছিলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর এই চারিত্রিক গুণটাকে বাহবা জানাই।’
তবে অনেক পাঠকই মনে করেন অবরোধে সহিংসতার দায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এড়াতে পারেন না। পাঠক রব লিখেছেন, ‘নিজের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে এই সংকট সৃষ্টির জন্য প্রধানত শেখ হাসিনা দায়ী।’ এ এম এ মুস্তাফিজুল মান্নান বলেন, ‘...হাসিনার একগুঁয়েমির বলি হচ্ছেন গীতাদিরা।’ আমির হোসেন লিখেছেন, ‘এসব মানুষের কান্না দেখেও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছাড়বেন না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাঠক প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘পদত্যাগ করে জীবন রক্ষা করেন।’ এ এন এম হাবিবের চাওয়া, ‘আমরা শক্ত সরকার চাই। যে আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে। কে নির্দেশ দিচ্ছে, কে মারছে, তা দেখতে চাই। প্রয়োজনে তাদের গুলি করুন, তবু আমরা আমাদের দেশে অন্তত নিরাপদে চলাফেরার অধিকারটুকু চাই।’ নিরাপত্তা দিতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন তাহমিনা এমি।
শেখ হাসিনার প্রতি সৌদি আরব থেকে সুমন বলেছেন, ‘সরকার যদি পারে জামায়াত-শিবির দমন করুন। নয়তো তালেবানের হাতে দেশ দিয়ে কেটে পড়ুন। যদি সেনাবাহিনী নামাতে হয় নামান, এসব আগুন পোড়া মানুষের আহাজারির চেয়ে সেনাশাসন অনেক ভালো।’ সুমনের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সৈয়দ মোজাদ্দাদ আল হাসনাত। আল আমিন মনে করেন, ‘লজ্জা হওয়া উচিত সরকারের।’ আমান মনে করেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর যদি বিবেক থাকত তাহলে এই গীতার কথার পর আর ক্ষমতা ধরে রাখতেন না। পদত্যাগ করতেন।’
তবে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না মনে করেন মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেই এর সমাধান হয়ে গেলে তো কয়েক দিন পর আবার বলবেন আওয়ামী লিগ না থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে তা ঠিক না। অন্যায় করে মানুষকে জিম্মি করে কোনো কিছু আদায় করা কোনো বিবেকবান মানুষের কাজ না। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করলে সেই অন্যায় বাড়বে। কোনো দিন কমবে না। হোক আওয়ামী লীগ, হোক বিএনপি। অন্যায় করলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন শৃঙ্খলভাবে, লিখুন সব জায়গায়।’ মনিরুলের সঙ্গে একমত মুস্তাক আহমেদ অপু।
(প্রথম আলোর অনলাইনে পাঠকের মন্তব্য থেকে)
No comments