সারদা-কাণ্ডে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ

উত্তপ্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। এবার ইস্যু সারদা-কাণ্ড। এই ইস্যু নিয়ে এখন তোলপাড় হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। বিরোধী দলের প্রতিবাদ, মিছিল, সমাবেশে জেরবার হচ্ছে রাজ্য রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় এই ইস্যু নিয়ে বিরোধী বাম দল ইতিমধ্যে তিন দিন বিধানসভার অধিবেশন বয়কট করেছে। রাস্তায় নেমেছেন বাম দল ও কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে বিজেপিও। মোট কথা, এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সারদা-কাণ্ড। আগামী বছরের এপ্রিল অথবা মে মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারতের পার্লামেন্ট বা সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার নির্বাচন। সেই নির্বাচনের আগে সারদা-কাণ্ড বিরোধী দলের হাতে নতুন এক অস্ত্র এনে দিয়েছে। আর শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে বাড়িয়ে দিয়েছে অস্বস্তি। এদিকে সব বিরোধী দলের একটাই দাবি উঠেছে রাজ্যব্যাপী, সারদা-কাণ্ড তদন্ত করাতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই দিয়ে। বিরোধীরা রাজ্য সরকারের পুলিশের তদন্তের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। রাজ্য সরকারও অনড়—সারদা ইস্যু যাতে সিবিআই পর্যন্ত না গড়ায়। বিরোধী দল যেমন মনে করছে, এই কাণ্ড সিবিআই দিয়ে তদন্ত করালেই বেরিয়ে পড়বে থলের বিড়াল।
ফাঁস হয়ে যাবে শাসক দলের বেশ কজন নেতা-মন্ত্রীর নাম। আর সে কারণেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বা মুখ্যমন্ত্রী এখনো চাইছেন না সারদা-কাণ্ড সিবিআই দিয়ে তদন্ত করাতে। যদিও ইতিমধ্যে এই দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও দায়ের হয়েছে অন্তত চারটি। দাবি উঠেছে, সারদা-কাণ্ড তদন্ত করাতে হবে সিবিআই দিয়ে। বিরোধীদের কথা, হাজার হাজার কোটি টাকার নয়ছয়ের হদিস রাজ্য পুলিশ করতে পারবে না। এ জন্য তাঁরা চান ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার তদন্ত। সিবিআইয়ের তদন্ত। আর এই ইস্যু নিয়ে এখন তোলপাড় হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের গোটা রাজনীতিতে। কেন সরকারের সিবিআই দিয়ে তদন্ত করাতে এত অনীহা? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সিবিআইয়ের তদন্ত হলেই বেরিয়ে পড়বে এই কাণ্ডের সঙ্গে কারা কারা জড়িত, তাঁদের নাম? এই ভয়ে রাজ্য সরকার চাইছে না সিবিআই দিয়ে তদন্ত করাতে। সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন যখন এ বছরের এপ্রিল মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কলকাতা থেকে পালিয়ে যান, তখনই তিনি সিবিআইকে লিখে যান এক চিঠি এবং তাতেই তিনি উল্লেখ করে যান ২২ জনের নাম, যাঁরা সারদা গোষ্ঠীর পতনের মূলে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছিলেন। যদিও ইতিমধ্যে সুদীপ্ত সেনের সেই তালিকায় উল্লিখিত তৃণমূল কংগ্রেসের এক সাংসদ, সাংবাদিক কুণাল ঘোষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের দিন আবার কুণাল ঘোষ তাঁর ফেসবুকে সারদা-কাণ্ডের কথা জানেন, এমন ১২ জনের নাম উল্লেখ করে যান।
এই তালিকায় রয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। আর এসব ঘটনায় এবার চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পর কুণাল ঘোষ হয়ে যান মমতার ছায়াসঙ্গী। যেখানে মমতা, সেখানে কুণাল ঘোষ। আর মমতাও কুণাল ঘোষের ওপর প্রচণ্ড আস্থা রেখে চলছিলেন। এর পুরস্কারও দেন মমতা কুণাল ঘোষকে। ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সাংসদ বা এমপি করেন তাঁকে। এদিকে কুণাল ঘোষকেও কাছে টেনে নেন সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। সুদীপ্ত সেনও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন মিডিয়াজগৎকে হাতে নেওয়ার। কিনতে থাকেন এক এক করে বিভিন্ন মিডিয়া। প্রিন্ট থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়া। এমনিভাবে সারদার হাতে চলে আসে ১০টি মিডিয়া। কলকাতা ও আসামে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু ভাষার ছয়টি দৈনিক এবং তারা, চ্যানেল-১০সহ চারটি টিভি চ্যানেল। আর মিডিয়া সেলের সিইও হয়ে যান তিনি। হঠাৎ ওলটপালট হতে থাকে সারদার সাজানো বাগান। সারদার মালিকানাধীন তারা মিউজিক ও তারা নিউজ চ্যানেলের কর্মীদের অনিয়মিত বেতন দেওয়া শুরু হয়। খবরটি চলে আসে অন্য মিডিয়ায়। কর্মীদের বেতন বাকিও পড়ে।
আন্দোলনে নামেন তারা টিভির কর্মকর্তা ও কর্মীরা। এরই মধ্যে এ বছরের ১০ এপ্রিল হঠাৎ গা ঢাকা দেন সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। তোলপাড় হতে থাকে কলকাতার রাজনীতিতে। উঠে আসে সারদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা শাসক দলের বেশ কজন মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কের নাম। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। সুদীপ্ত সেন কলকাতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় একটি চিঠি লিখে যান ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইকে। ১৮ পাতার ওই চিঠিতেই সুদীপ্ত সেন জানিয়ে যান, কেন তাঁর এত বড় সাম্রাজ্যের পতন হলো। এ জন্য তিনি দায়ী করেছেন শাসক দলের বেশ কজন নেতা, মন্ত্রীসহ ২২ ব্যক্তিকে, যাঁরা তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করে দিনের পর দিন আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন সারদা গোষ্ঠী থেকে। এই চিঠিকে সুদীপ্ত সেন এফআইআর হিসেবে গণ্য করে মামলা দায়ের করার জন্য অনুরোধও জানিয়ে যান সিবিআইকে। ইতিমধ্যে অর্থলগ্নিকারীদের সাড়ে ১৮ লাখের বেশি আবেদন পড়ে সরকারের কাছে। এদিকে কুণাল ঘোষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর সারদা-কাণ্ড সিবিআইকে দিয়ে তদন্তের জোর দাবি ওঠে। বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, বিজেপি—সব দলই এক দাবিতে অনড় থাকে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা জানেন, এই কেলেঙ্কারির তদন্তভার যদি সিবিআইয়ের হাতে চলে যায়, তবে আরও বেরিয়ে পড়বে শাসক দলের কেলেঙ্কারির নানা কাহিনি। ফলে তিনি শুরু করেন সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা। অন্যদিকে বিরোধীরাও নাছোড়বান্দা। তাঁরাও শুরু করেন রাজ্যব্যাপী সিবিআই তদন্তের দাবিতে আন্দোলন। সেই আন্দোলন এখনো চলছে। দিনে দিনে জোরদার হচ্ছে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.