সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই ডেসটিনির পুরো সম্পত্তি by ফখরুল ইসলাম

ডেসটিনির স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। আবার এক বছর হতে চললেও ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে করা মামলার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হয়নি।
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, জমি, ফ্ল্যাট ও গাড়িসহ ডেসটিনির যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যবস্থাপনা এবং তদারকির দায়িত্বও পুলিশের। কিন্তু স্বাভাবিক কাজের বাইরে গিয়ে এ দায়িত্ব পালন করা পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে ৯ জুলাই জরুরি বৈঠক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপি কার্যালয়ের ওই বৈঠকে ডেসটিনির পুরো সম্পত্তি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এনে সেগুলো যথাযথভাবে পরিচালনা নিয়ে আলোচনা হয়। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডসহ ডেসটিনি গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার জন্য গত ২৭ নভেম্বর নির্দেশ দেন আদালত। এ ব্যাপারে আদালত গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে রিসিভার নিয়োগ করেন।
ডিএমপি ডেসটিনির জমি, ফ্ল্যাট ও গাড়িসহ যাবতীয় সম্পত্তি জব্দের দায়িত্ব দেয় ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মো. শাহাবুদ্দিন খানকে। গঠন করা হয় ‘ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড নামক কোম্পানির ক্রোককৃত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি-সংক্রান্ত আহ্বায়ক কমিটি।’ শাহাবুদ্দিন খান এ কমিটির আহ্বায়ক।
যোগাযোগ করলে মো. শাহাবুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষে ডেসটিনির পুরো সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। জটিলতার কারণে অবশ্য অনেক সম্পত্তি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’ ‘এ সম্পত্তির রিসিভার (তত্ত্বাবধায়ক) পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি, ঢাকা’ শিরোনামে সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর ফার্মগেটের আনন্দ-ছন্দ সিনেমা হল ও কল্যাণপুরের কাছাকাছি দারুসসালাম এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের জন্য কেনা জমিসহ আরও কয়েকটি জায়গায় সাইনবোর্ড রয়েছে। তবে ডেসটিনির সম্পত্তি ঢাকার ৩৩ নম্বর পুরানা পল্টন লাইনের স্থাপনাবিহীন বাড়ি এবং বাংলামোটরে নাসির ট্রেড সেন্টারে পাঁচ হাজার বর্গফুট ফ্লোরের সামনে কোনো সাইনবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, ডেসটিনি গ্রুপের ১১৬টি গাড়ির মধ্যে জব্দ হয়েছে অর্ধেক। এগুলোর অবস্থা জানতে চাইলে শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘এগুলো বসে নেই। রাস্তায় চলছে।’ পুলিশ ব্যবহার করছে কি না প্রশ্নের জবাব দেন তিনি পাল্টা প্রশ্নে, ‘না, না, পুলিশ কেন ব্যবহার করবে?’
প্রসঙ্গত, ডেসটিনির প্লট ও ফ্ল্যাট জব্দ এবং তদারকির দায়িত্ব রাজধানীর ২০টি থানার ওপর।
ডেসটিনির ৩৭টি ফ্ল্যাট-প্লট: ডিএমপির তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীতে ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল আমীনেরই ২৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। তাঁর স্ত্রী ফারাহ দীবার নামে রয়েছে একটি প্লট ও একটি ফ্ল্যাট।
তেজগাঁও থানার আওতাধীন ফার্মগেট তেজতুরী বাজারে বিভেক জান্নাত নামক ভবনে ১৬টি ফ্ল্যাটই রফিকুল আমীনের। জোয়ারসাহারার লেকসিটি কনকর্ডে আটটি, মগবাজারে একটি, ধানমন্ডিতে দুটি এবং খিলক্ষেতে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট।
পুরান ঢাকার ২৫ নম্বর কোর্ট হাউস স্ট্রিট ভবনে ১৪ শতাংশের প্লট এবং ধানমন্ডিতে দুই হাজার ৬৩৩ বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে ফারাহ দীবার নামে। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইনের নামে সিদ্ধেশ্বরী, খিলগাঁও, গোগারিয়া, ক্যান্টনমেন্ট ও ভাটারায় প্লট-ফ্ল্যাট রয়েছে।
গত ২৭ নভেম্বর ডেসটিনির এমডিসহ কারাগারে থাকা আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই দিনই তাঁদের সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরের নির্দেশ দেন আদালত। তার আগে গত বছরের ৩১ জুলাই দুদক রফিকুল আমীনসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুটি মামলা করে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা। রফিকুল আমীন, মোহাম্মদ হোসাইন ও ডেসটিনির পরিচালক দিদারুল আলম এখন কারাগারে। ডেসটিনির চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ শর্তসাপেক্ষে জামিনে রয়েছেন।
১ জুলাই ডেসটিনি মাল্টিপারপাসের কোষাধ্যক্ষ আকবর আলী ওরফে সুমন আকবর জামিন পেলেও দুদকের আপিল আবেদনে এ জামিন বাতিল করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার আদালত আকবর আলীকে নিম্ন আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলেও তিনি হাজির হননি। ২৩ আসামির অন্যরা এখনো পলাতক।
ঢাকার বাইরে ডেসটিনির সম্পত্তি: দুদক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের ২২টি জেলায় ডেসটিনির বিপুল সম্পত্তি রয়েছে। জেলারগুলোও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় রয়েছে ২৪টি রাবার বাগান। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, এগুলোর হস্তান্তর বা বিক্রি নিষিদ্ধ।
ডেসটিনির সম্পদ মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত। কিছু সম্পদ গ্রুপভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। আর কিছু আছে গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ব্যক্তি নামে। তবে গ্রুপভুক্ত ৩৭ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস এবং ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের সম্পত্তি সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের।
রাজধানীর পরে মুন্সিগঞ্জ জেলায় এ প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে। জেলার সিরাজদিখানেই রয়েছে তিন হাজার শতাংশ জমি। এ ছাড়া রাজশাহীতে বর্ণালী সিনেমা হল, খুলনায় সাত একর জমি, ছয় বিভাগীয় শহরে ডেসটিনি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার (ডিআইবিসি) নির্মাণের জমি, কক্সবাজারে হোটেল নির্মাণের জমি ও গাজীপুরে ডেসটিনি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য জমি রয়েছে।
দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মোজাহার আলী সরদার গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা এবং জেলাগুলোর কিছু সম্পত্তি এখনো পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কিছু জমির দাবিদার অন্যরা। তাই ঝামেলা হচ্ছে।’ আগামী আগস্টের শেষ দিকে তদন্ত প্রতিবেদন শেষ হবে বলে জানান মোজাহার আলী সরদার।
রফিকুল আমীনের অবর্তমানে ডেসটিনির সবকিছু দেখাশোনা করে আসছিলেন তাঁরই ভাইয়ের ছেলে আশরাফুল আমীন। সম্প্রতি এ দায়িত্ব পেয়েছেন ডেসটিনি গ্রুপের কোম্পানি সচিব মিজানুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, ডেসটিনির প্রায় সব সম্পত্তিই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। আমরা চাইলেও এগুলো বিক্রি করতে পারব না।’ তবে একসময় সব জটিলতার অবসান হবে বলে তিনি আশাবাদী।
ডেসটিনির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা অবশ্য প্রথম আলোকে এ-ও জানান, সবকিছুর পরও ডেসটিনির সম্পত্তি বিক্রি চলছে। ডেসটিনির একটি প্রাডো গাড়ি চট্টগ্রামে জালিয়াতির মাধ্যমে তিনজনের কাছে বিক্রি হয়েছে, যা নিয়ে দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে।
ডেসটিনির ৬৩১ কোটি টাকার দলিলমূল্যের সম্পত্তির প্রকৃত মূল্য চারগুণ বেশি হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ সংবাদ শুনতে আপনার মোবাইল ফোন থেকে ডায়াল করুন ২২২১

No comments

Powered by Blogger.