জনপ্রশাসনে অদক্ষতা বাড়ছে নানা কারণেই by ইকতেদার আহমেদ

ব্যাপক অর্থে আমাদের দেশের প্রশাসন দু’ভাগে বিভক্ত। এর একটি হল সামরিক প্রশাসন আর অপরটি বেসামরিক প্রশাসন। বেসামরিক প্রশাসনের আরেক নাম জনপ্রশাসন। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে কী পদ্ধতি অনুসৃত হবে তা সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেনা, নৌ ও বিমান এ তিনটি বাহিনীর সমন্বয়ে সামরিক প্রশাসন গঠিত। প্রতিটি বাহিনীর নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে কর্মকর্তা, সৈনিক ও কর্মচারীদের নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ-পরবর্তী কর্মকর্তা ও সৈনিকদের কঠোর প্রশিক্ষণ অনুশীলন করতে হয়। কর্মকর্তা ও সৈনিক উভয়ের ক্ষেত্রে শারীরিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া কোটা সংক্রান্ত কোনো বিধিবিধান না থাকায় যোগ্য ও মেধাবীরা নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন। জনপ্রশাসনে অধস্তন আদালতের বিচারক ছাড়া অপর সব বিভাগের ক্যাডার ও ক্যাডারবহির্ভূত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা এবং অধিকাংশ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। অধস্তন আদালতের বিচারকরা আগে সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে এলেও উচ্চাদালতের আপিল বিভাগের রায়-পরবর্তী ১৯৯৮ সাল থেকে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
জনপ্রশাসনের সব বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা স্ব-স্ব বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত হন। জনপ্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি অনুসৃত হয়। ইংরেজি Quota শব্দটির অর্থ Proportional share যার বাংলা অর্থ আনুপাতিক অংশ। তবে কোটা শব্দটিই বহুল ব্যবহত।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সংরক্ষণ সরকারের নীতির একটি অংশ। তবে যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোটা সংক্রান্ত নীতির প্রয়োগ গণতন্ত্রের বিধানাবলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং এটি দীর্ঘদিন অনুসৃত হওয়া কাম্য নয়। আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব মূলনীতির কথা বলা হয়েছে, তার একটি হল সুযোগের সমতা। সুযোগের সমতা বিষয়ে সংবিধানের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদের (১), (২) ও (৩) নম্বর দফায় পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা হয়েছেÑ (১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবেন। (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমানস্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। (৩) জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে যেসব মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা। এ বিষয়ে ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদের (১) ও (২) দফা এবং (৩) নম্বর দফার (ক), (খ) ও (গ) উপদফায় পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা হয়েছে- (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জš§স্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। (৩) এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই- (ক) নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হতে, (খ) কোনো ধর্মীয় বা উপসম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করা হতে, (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেরূপ যে কোনো শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না। সংবিধানের ১৯ ও ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদের বিধানাবলীর প্রতি আলোকপাত করলে পরিলক্ষিত হয় ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে সাধারণ অর্থে অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে, অপরদিকে ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বিশেষ অর্থে অর্থাৎ সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে এবং এর পাশাপাশি নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ বিষয়ে রাষ্ট্রকে বিশেষ বিধান প্রণয়নে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন বেসামরিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার যে বিভাজন রয়েছে তা হল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটা শতকরা ৩০ ভাগ, জেলা কোটা ১০ ভাগ, মহিলা কোটা ১০ ভাগ, উপজাতি কোটা ৫ ভাগ এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১ ভাগসহ সর্বমোট ৫৬ ভাগ। এ ধরনের কোটা সংরক্ষণ মেধা লালনের ক্ষেত্রে কতটুকু সহায়ক তা বিবেচনার দাবি রাখে।
সংবিধানের ২৯(৩)(ক) অনুযায়ী নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়নের পর প্রজাতন্ত্রের কর্মে তাদের প্রতিনিধিত্ব যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এ বিধানের কার্যকারিতা থাকা উচিত নয়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, তারাই তো মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কথা। কিন্তু ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন ও বিয়োজনের ঘটনা ঘটছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণে বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের প্রারম্ভিক যে কোনো পদে নিয়োগ লাভের সুযোগ না থাকায় এ সুযোগটি তাদের সন্তান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। সচেতন দেশবাসীর প্রশ্ন, এ ধরনের সম্প্র্রসারণ কতটুকু যৌক্তিক? তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হবে সে নিশ্চয়তা সবার ক্ষেত্রে দেয়া কি সম্ভব?
নারীরা নিজ মেধা ও যোগ্যতার কারণে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে ভালো করছে। সে বিবেচনায় কোটার মাধ্যমে তাদের সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন আছে, সম্ভবত এমনটি ভাবার অবকাশ কমে আসছে। কোটার কারণে মেধাবীরা নিয়োগ লাভে বঞ্চিত হচ্ছেন। অপরদিকে স্বল্প মেধাবীদের আধিক্য ঘটছে। এভাবে জনপ্রশাসনে স্বল্প মেধাবীর সংখ্যা যত বেশি হবে, জনপ্রশাসনের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব তত বেশি নিুগামী হবে। তবে বর্তমানে জনপ্রশাসন যে কাক্সিক্ষত মান রক্ষা করতে পারছে না, তার কারণ শুধু কোটা পদ্ধতি নয়।
২০০১-পরবর্তী জনপ্রশাসনের উপসচিব থেকে সচিব অবধি উচ্চতর পদসমূহে সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে কর্মকর্তাদের ওএসডি করার বিধান স্থায়ী রূপ পেয়েছে। এ স্থায়ী রূপ পাওয়া পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, জনপ্রশাসন রাজনৈতিক কারণে দুটি শিবিরে বিভক্ত। এর একটি হচ্ছে আওয়ামীপন্থী আর অপরটি বিএনপি ও জামায়াতপন্থী। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের সঙ্গে জনপ্রশাসনবিষয়ক একটি টকশোতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ টকশোটি যাদের দেখার সুযোগ হয়েছিল তারা বুঝেছেন একজন সাংবাদিকের জ্ঞানের কাছে দু’জন জ্যেষ্ঠ সচিবের জ্ঞান কত তুচ্ছ। একজন রাজনৈতিক মন্ত্রী তার ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) নিয়োগের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। তাদের অধিকাংশের কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও সরকার পরিবর্তনের পর তাদের ওপর অনাহুত ওএসডি’র খড়গ নেমে আসে। এতে করেও মেধাবীরা অহেতুক হয়রানির শিকার হচ্ছেন আর অপেক্ষাকৃত স্বল্প মেধাবীরা অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও লোভনীয় পদে আসীন হচ্ছেন।
সরকারের একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৮১ ও ৮৩ ব্যাচের সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের বিবেচনা না করে পরবর্তী সময় নিয়োগবিধি শিথিল করে ওই বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শুধু মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে বিশেষ উদ্দেশ্যে যেসব কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে নিুে অবস্থানকারী একজনকে সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ নিয়োগের কারণে বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ভুক্ত বিভাগের জ্যেষ্ঠ, দক্ষ, সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তারা হতবাক, বিস্মিত ও মর্মাহত হন। তাদের অভিমত, এ ধরনের নিয়োগ বিভাগে শুধু শৃঙ্খলাই নষ্ট করে না, বিভাগে অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়ও সহায়ক হয়। সম্প্রতি সরকারি কর্মকমিশন সরকারের বিভিন্ন ক্যাডার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০০ নম্বরের প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করায় নিয়োগ প্রত্যাশী কোটাবহির্ভূতদের মধ্যে এমন ধারণা হচ্ছে যে, কোটাধারীদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য নিয়োগ পরীক্ষার প্রারম্ভিক ধাপে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। যদিও কোটাবহির্ভূত নিয়োগ প্রত্যাশীদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে সরকারি কর্মকমিশন তাদের গৃহীত পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে এসেছে বলে দাবি করেছে, তবে কোটাবহির্ভূত নিয়োগ প্রত্যাশীরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক আয়োজিত প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষায় আগে কখনও কোটা পদ্ধতি অনুসৃত হয়নি। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ক্ষেত্রে কোটা থাকলেও তাদের পৃথকভাবে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের আবশ্যকতা ছিল। কিন্তু যখন দেখা গেল, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ হওয়ায় বিশেষ জেলা ও বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রার্থীকে কাক্সিক্ষত ক্যাডার পদ দেয়া যাচ্ছে না, তখন বিশেষ উদ্দেশ্যে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে ২০০-তে উন্নীত করা হয়। রাজনৈতিক সরকার সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। এতে করে তারা কতটুকু নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়ে দেশবাসীর সংশয় রয়েছে।
অন্যান্য দেশে কোটা সংরক্ষণ একটি সাময়িক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থাটি আমাদের দেশে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বেসামরিক জনপ্রশাসন নিু মেধার কর্মকর্তাদের প্রাধান্যে অকার্যকর হয়ে পড়বে, যার প্রভাব আমরা ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছি।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জেলা জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিমকোর্ট

No comments

Powered by Blogger.