রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ কোথায়? by আনু মুহাম্মদ

গত কিছুদিন ধরে বেশ কয়েকটি পত্রিকার অর্ধপৃষ্ঠা জুড়ে বিজিএমইএ’র বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে তারা সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। হাতে হাত ধরে উন্নতির কথা বলেছেন। কিন্তু কী কাজে এই সহযোগিতা দরকার তাদের? গার্মেন্ট খাত পুনর্গঠনের কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন তারা? রানা প্লাজার নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করে তাতে সহযোগিতা চাইছেন? সব কারখানায় নিয়মিত মজুরি পরিশোধে তদারকিতে সহযোগিতা দরকার? ঈদের আগে সব বকেয়া, বোনাস, ওভারটাইম পরিশোধে তারা আগ্রহী? না, এগুলোর কোনো লক্ষণই নেই। রানা প্লাজা ধসের পর তিন মাস হতে চলল। কয়েক হাজার পরিবারের আহাজারি আর বিলাপ কিছুমাত্র কমেনি। নিহত ও গুরুতর আহত শ্রমিকদের স্বজনদের এ সময়ে টিকে থাকা, বেঁচে থাকার পথই অনিশ্চিত। যারা আহত হয়ে বেঁচে আছেন, তাদের অনেকে পুরোই অন্ধকার দেখছেন চোখে। ‘মরে যাওয়াই ভালো ছিল’- এটাই তাদের এখনকার হাহাকার। তাজরিনের ঘটনার পরেই যেখানে সরকার, মালিক, বিজিএমইএ, বায়ারদের একটু সংযত হওয়ার কথা, নিজেদের স্বার্থে হলেও টেকসই শিল্প গড়ে তোলার জন্য দূরদৃষ্টি নিয়ে শিল্পের শ্রমিকের বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার কথা, সেখানে এটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা যে, রানা প্লাজার মতো দুনিয়া কাঁপানো ও দেশ কাঁদানো ঘটনা/হত্যাকাণ্ডের পরও তাদের ভাবভঙ্গির কোনো পরিবর্তনই দেখা যাচ্ছে না। নইলে এটা কী করে সম্ভব যে, লাশের পাহাড় তৈরি করেও- দিন-মাস পার হয়ে যাচ্ছে- এখনও ক্ষতিপূরণের কোনো ঘোষণা নেই? শিল্প পুনর্বিন্যাসের যথাযথ উদ্যোগ নেই? প্রধানমন্ত্রী বিভিন্নজনের কাছে চাঁদা তুলে কিছু টাকা একাংশের হাতে দিয়েছেন। ১১৩০ জন নিহতের পরিবার এবং আহত পঙ্গুদের অধিকাংশ সেটাও পাননি। প্রধানমন্ত্রী যা দিয়েছেন এবং হয়তো সামনে আরও দেবেন, এটাকে প্রাথমিক সহায়তা হয়তো বলা যায়, কিন্তু ক্ষতিপূরণের কী হল?
মানুষের জীবনের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। কিন্তু যখন কারও অপরাধে অন্য কারও জীবন যায়, কিংবা অচল হয়ে পড়ে কেউ, তখন ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন আসে দুটি কারণে। প্রথমত, নিহত হওয়ার কারণে তার পরিবারের যে অসহায় অবস্থা তাকে আর্থিকভাবে কিছুটা সামাল দেয়া এবং দ্বিতীয়ত, অপরাধী ব্যক্তির জন্য একটা আর্থিক চাপ তৈরি করা যাতে ভবিষ্যতে অন্যরা একই ধরনের অপরাধ না করে।
তাজরিন ফ্যাশনের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয়েছে ৬ বা ৭ লাখ টাকা করে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল ও মন্ত্রণালয়ের টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকা আছে। বিজিএমইএ ও বায়ার আছে, কিন্তু মালিকের কাছ থেকে কোনো টাকার কথা শোনা যায়নি। এখনও নিখোঁজ কয়েকজন বাকি আছে, আহতদের অনেকের চিকিৎসার খবর নেই। রানা প্লাজার ভয়ংকর ঘটনার পর বিজিএমইএ নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ক্ষতিপূরণের অর্থ অন্তত তাজরিনের চেয়ে কম হবে না। বেশিই হবে। বলেছেন, আহতদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব তাদের। মিডিয়ার যতদিন মনোযোগ ছিল ততদিন এসব কথা শোনা গেছে। মিডিয়া সরে গেছে, তাই তাদের কথা আর কাজে যথারীতি ব্যাপক ফারাক। তারা কী আশা করছেন? সময়ে সবাই ভুলে যাবে? দেশের আরও অঘটনে চাপা পড়ে যাবে তাদের সব কলংক?
ক্ষতিপূরণ কত হওয়া উচিত সেটা নিয়ে নানা হিসাব আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষারত কয়েকজন প্রবাসী শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদ্ধতি ও দেশের বিদ্যমান মজুরি কাঠামো বিশ্লেষণ করে ক্ষতিপূরণের একটি ছক দিয়েছেন। তাতে ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় সর্বনিু ৯ লাখ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৫৪ লাখ টাকা (প্রথম আলো, ২৭ মে, ২০১৩)। তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়ই আমরা দেখেছিলাম, ১৮৫৫ সালের চরম দুর্ঘটনা আইন অনুযায়ী গড়ে কম করে ধরলেও ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় ৪৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে আইএলওসহ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মজুরি কাঠামো বিবেচনা করে পরিবারপ্রতি ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবারই অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। অনুপাত অনুযায়ী সরকার শতকরা ৯ ভাগ, বিজিএমইএ শতকরা ১৮ ভাগ, মালিক ২৮ ভাগ এবং ব্র্যান্ড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান শতকরা ৪৫ ভাগ বহন করবেন।
রানা প্লাজার ভয়ংকর জীবননাশের পর দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু সভা-সম্মেলন হচ্ছে, অনেকরকম প্রতিশ্র“তিও শোনা যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে টাকাও উঠেছে। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে এখনও কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি বিজিএমইএ বা সরকার। ক’দিন আগে বাজেট পাস হল। খুবই স্বাভাবিক ছিল, এই বাজেটে গার্মেন্ট খাতের জন্য সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রূপরেখা থাকবে। কিন্তু বাজেটে এ ধরনের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। অথচ গার্মেন্ট খাতের ভঙ্গুর দশার জন্য সরকারের দায় অনেকখানি। ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরদের এখনও যা সংখ্যা ও ক্ষমতা, তাতে গার্মেন্ট খাতের তত্ত্বাবধানে সরকারের যে কোনো আগ্রহ নেই সেটাই বোঝা যায়। সবকিছু ছেড়ে দেয়া আছে মালিকদের যথেচ্ছাচারের ওপর। কিন্তু কারখানা যদি ভুল স্থান ও ভুল ভবনে স্থাপিত হয়, যদি সেখানে মুনাফার সীমাহীন লোভে ব্যক্তি মালিক শ্রমিক নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না রাখে, তাহলে সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সরকারেরই। এই কাজ না করলে শিল্প মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় আছে কেন? দুর্যোগ মোকাবেলায় ফায়ার ব্রিগেডকে শক্তিশালী করার বড় পরিকল্পনা খুবই স্বাভাবিক ছিল, বাজেটে তারও প্রতিফলন নেই।
এর মধ্যে গার্মেন্ট খাতকে শায়েস্তা করার ঘোষণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছেন। এটা এক অদ্ভুত ঘোষণা! কারণ বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পায় না, কখনোই পায়নি। বরং অন্য অনেক দেশের তুলনায় ৫ থেকে ১৫ গুণ বেশি শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে। এরকম বৈষম্যমূলক ও সংরক্ষণবাদী শুল্কনীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার বা বিজিএমইএ’কে কখনও কথা বলতে শুনিনি। বরং তারা সবসময় হাতে-পায়ে ধরার পথেই আছেন। যা বাংলাদেশ পায় না, সেটা স্থগিত করার অর্থ কী? সঙ্গত কারণেই গার্মেন্টকে শায়েস্তা করার কথা বলে জিএসপি স্থগিত করায় গার্মেন্টের রফতানি কমারও সম্ভাবনা নেই। গার্মেন্ট শিল্পের মুনাফার বড় ভাগীদার ব্র্যান্ড ও বায়িং হাউস। তারাও নিজেদের স্বার্থেই রফতানি নিশ্চিত করবে। কিন্তু ক্ষতির মুখে পড়ছে বাংলাদেশের রফতানিকৃত পণ্যের মধ্যে অন্যগুলো যেমন- প্লাস্টিক, সিরামিক, খাদ্য, মানুষের চুল, পাখির পালক, খেলনা ইত্যাদি। এগুলো মোট রফতানির শতকরা ১ ভাগেরও কম। এগুলো উদীয়মান শিল্প, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অভিযোগ এদের বিরুদ্ধে শোনা যায়নি। অথচ তারাই শাস্তিপ্রাপ্ত।
রফতানি কমার সম্ভাবনা না থাকলেও মার্কিন ঘোষণার কারণে গার্মেন্ট খাতে এখন ব্র্যান্ড ও বায়ারদের বিভিন্ন স্তর থেকে দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। তারা মার্কিন এই শাস্তির সূত্র ধরে আরও দাম কমানোর চাপ দিতে পারে। দাম কমানোর পর নিজের মুনাফা ধরে রাখতে মালিকরা প্রয়োজনীয় কাজে খরচ আরও কমানোর পথে যেতে পারে। জিএসপির ভয় দেখিয়ে মালিকদেরও শ্রমিকদের সঙ্গে দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হল। প্রকৃত মজুরি কমাতেও নানা কায়দা-কানুন দেখা যাবে। সবার মুনাফা রক্ষা করতে গিয়ে শ্রমিকের ওপর সব চাপ ফেলার এই ধারা বরাবর চলছে, সেটাই আরও জোরদার করার অবস্থা তৈরি করল ওবামা সরকার। অর্থাৎ শ্রমিক স্বার্থের কথা বলে জিএসপি স্থগিত করলেও শ্রমিকদের জন্য নতুন হুমকি তৈরি করল তারা।
এটা নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প বর্তমানের অবস্থায় চলতে পারবে না। বাংলাদেশের গার্মেন্টের সঙ্গে যুক্ত একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী সেখানকার এক পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বর্তমানে এই শিল্পে ভারত ও শ্রীলংকার বায়িং হাউস এবং কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। যৌথ বিনিয়োগ আছে। প্রায় ৪০০টি ভারতীয় বায়িং হাউস কাজ করছে এখানে। সাবকন্ট্রাক্টও দিচ্ছে তারা বাংলাদেশে (দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন, জুন ৩, ২০১৩)। পাশাপাশি ভারত তার দেশে গার্মেন্ট শিল্পকে একটি শক্তপোক্ত জায়গায় দাঁড় করাতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পাটশিল্পের মতোই এই পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন ভারতকে গার্মেন্টের ক্ষেত্রেও শক্তিশালী জায়গায় প্রতিষ্ঠা করবে।
একটি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ অবকাঠামো আর শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম শ্রমিকের জীবন ও নিরাপত্তা ছাড়া কিছু লোক কিছুদিন মুনাফার পাহাড় গড়তে পারে, কিন্তু তাতে শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি স্থগিত নিয়ে মাতামাতি, দোষারোপ, কাকুতিমিনতি আর হাতে-পায়ে ধরে কোনো ফল হবে না। এমনিতেও গার্মেন্ট কোনো জিএসপি সুবিধা পায়নি, মার্কিন বাণিজ্যনীতি অনুযায়ী ভবিষ্যতেও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় নতুন নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে। সর্বোপরি, গার্মেন্ট শিল্প সাবালক কাঠামোয় স্থাপন করার জন্য একটি সামগ্রিক পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার। নিহত ও আহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ, গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম মজুরি, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন এবং সেই সঙ্গে কারখানা ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা এর প্রাথমিক ধাপ।
এগুলো না করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেয়ার অর্থ নিজেদের অপরাধ ঢাকা দেয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কী হতে পারে?
আনু মুহাম্মদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.