চট্টগ্রামে দরপত্রের নিয়ন্ত্রক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ by একরামুল হক ও প্রণব বল

চট্টগ্রামে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়নকাজের বেশির ভাগ দরপত্রই নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। এদের অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত।
দরপত্রের নিয়ন্ত্রণ ও কাজ পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ে এসব ক্যাডারের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছে।
পুলিশসহ স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, সাড়ে চার বছর ধরে রেলের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হেলাল আকবর চৌধুরী, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক সাইফুল আলম, যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসী শহীদুল ইসলাম ওরফে শামীম ও খোকন চন্দ্র তাঁতী এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মশিউর রহমান ওরফে দিদার ও দিদারুল আলম ওরফে দিদার। গত সোমবারের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর তাঁরা সবাই গা ঢাকা দেন। তাঁদের মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
রেলওয়ের ৯৬ লাখ টাকার কাজের দরপত্র জমা দেওয়া নিয়ে গত সোমবার ছাত্রলীগের সাইফুল আলমের ক্যাডারদের সঙ্গে যুবলীগের হেলাল আকবর চৌধুরীর ক্যাডারদের সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়। এর আগের দিন রোববার উভয় পক্ষের ক্যাডাররা এই দরপত্র নিয়ে নগরের একটি রেস্তোরাঁয় সমঝোতা বৈঠকে বসে। বৈঠকে সমঝোতা না হওয়ায় পরদিন রেলের পূর্বাঞ্চল সদর দপ্তর এলাকায় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুগ্ম সচিব মর্যাদার রেলের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে দপ্তর থেকে প্রতিবছর অন্তত ১০০ কোটি টাকার কাজের দরপত্র ডাকা হয়। এর মধ্যে পূর্ত কাজে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কাজও পেশাদার ঠিকাদারেরা করেন না। তিনি বলেন, ছোট ছোট কাজের প্রতি রাজনৈতিক ক্যাডারদের আগ্রহ বেশি। কারণ, এ ক্ষেত্রে বিশেষ অভিজ্ঞতা লাগে না। অল্প বিনিয়োগে লাভ বেশি, এ কারণে প্রতিযোগিতাও বেশি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, যুবলীগের নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেন। পরে থাইল্যান্ড পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ওই দেশের জেলে পাঠায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি দেশে ফেরেন। নগরের নন্দনকানন এলাকায় তাঁর আস্তানা। রেলের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম এমইএস কলেজ এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হেলাল আকবর চৌধুরীর সঙ্গে জোট বেঁধেছেন খোকন চন্দ্র তাঁতী নামের যুবলীগের আরেক ক্যাডার। গত সোমবারের সংঘর্ষে খোকনকেও গুলিবর্ষণ করতে দেখেছে স্থানীয় লোকজন। খোকনের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালের মার্চে নগরের টাইগারপাস মোড়ে সিটি কলেজের ছাত্রসংসদের সাবেক জিএস আমিনুল ইসলামকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তিনি ওই হত্যা মামলার আসামি।
আওয়ামী লীগ সরকার শপথ নেওয়ার পরদিন থেকে সিআরবি এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন যুবলীগের ক্যাডার শহীদুল ইসলাম। যুবলীগের কোনো পদে তিনি নেই। তবু তিনি যুবলীগের নেতা। তিনিও সিটি কলেজের সাবেক জিএস আমিনুল ইসলাম হত্যা মামলার আসামি। তাঁর বিরুদ্ধে পোশাক কারখানার টাকা ছিনতাই করার মামলাও রয়েছে।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মশিউর রহমান ওরফে দিদারের আস্তানা জাকির হোসেন রোডে। তাঁর একটি সন্ত্রাসী বাহিনীও রয়েছে বলে স্থানীয় একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও সিআরবি এলাকায় দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ রয়েছে।
‘টেন্ডারবাজ’ হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের সাবেক আরেক নেতা দিদারুল আলম নগর আওয়ামী লীগের নেতা আ জ ম নাছিরউদ্দিনের অনুসারী। দিদারুল আলম গত ২৫ মে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পাঁচলাইশ থানায় হাঙ্গামা করে আলোচনায় আসেন। তাঁর হাত ধরেই সিআরবি এলাকায় দরপত্র-সন্ত্রাসে সম্পৃক্ত হন ছাত্রলীগের নেতা সাইফুল আলম।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক হয়েই সাইফুল বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্র বছর খানেক ধরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে দরপত্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। সোমবারের সংঘর্ষে একটি পক্ষে তাঁকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।
গতকাল গিয়ে দেখা যায়, রেল ভবনের দরপত্রসংক্রান্ত কার্যালয়ের কক্ষের আশপাশের দেয়ালে সাইফুলের নামে রঙিন পোস্টার সাঁটানো। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক হওয়ার পর দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এসব পোস্টার সাঁটানো হয়। পোস্টারে সাইফুলের বিশাল ছবির ওপরে সভানেত্রী শেখ হাসিনার ছবি রয়েছে।
জানতে চাইলে সাইফুল আলম টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এক বছর ধরে রেলওয়েতে কিছু কাজ করছি। আমার নিজের লাইসেন্স নেই। তবে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা দিদারুল আলম ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র জমা দিয়ে আমি ইতিমধ্যে বেশ কিছু কাজ করেছি।’ তিনি বলেন, গত সোমবার সকালে তিনি দিদারুল আলমের প্রতিষ্ঠান রয়েল অ্যাসোসিয়েটের নামে দরপত্র জমা দিতে যান।
দিদারুল আলম দাবি করেন, ‘আমি যেহেতু ছাত্রলীগ করি, তাই অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। তবে সোমবার সাইফুলকে আমি কোনো দরপত্র জমা দিতে বলিনি।’
মাছ কাদেরের নিয়ন্ত্রণে পিডিবি: অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করেন আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের নামে যুবলীগের এক ক্যাডার। এখানে কাজ পেতে হলে মাছ কাদেরকে ৮ থেকে ১০ শতাংশ ‘কমিশন’ দিতে হয়।
প্রায় নয় বছর কারাভোগ করার পর বর্তমান সরকারের আমলে মুক্তি পান মাছ কাদের। এরপর আগ্রাবাদ এলাকায় পিডিবির কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে নগর পুলিশের কমিশনার ও র‌্যাবের কাছে পিডিবি ঠিকাদার কল্যাণ সমিতি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে একাধিকবার।
জানতে চাইলে মাছ কাদের গতকাল সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড: পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন চট্টগ্রামে বছরে গড়ে অর্ধশত কোটি টাকার উন্নয়নকাজের দরপত্র হয়। এখানে কাজ পেতে হলে যুবলীগের ক্যাডার সোহেল রানাকে ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এক ঠিকাদারের করা মামলায় সোহেল রানাকে ১৩ জুন নগরের বাদুরতলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.