বিশেষ সাক্ষাৎকার : মুনীরা খানরাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে নিরপেক্ষ নির্বাচন

চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দেশের মানুষের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি হলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সামনে রয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, সরকারের অবস্থান, কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনীরা খান। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মুনীরা খান : নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, নিরপেক্ষ কতটা হবে, তার অনেকাংশই নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও তাদের স্বচ্ছতার ওপর। তাই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য যেমন তারা প্রশংসা পেতে পারে, আবার বিপরীতটাও তাদের ওপরই বর্তায়।
চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই আমরা পর্যবেক্ষণ শুরু করেছি। প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণ থেকে শুরু করে বিলবোর্ড, ব্যানার- এমনি নানা বিষয় আমাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় ছিল। কিছু এলাকায় বিলবোর্ড ব্যবহার করতে দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশন সেগুলোর বিষয়ে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে। আসলে নির্বাচন কমিশনকেও কাজ করতে হয় নানা দিক চিন্তা করে। কিছু বিলবোর্ড শেষ পর্যন্তও দেখা গেছে। দু-এক জায়গায় প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে কিছু ঘটনা ঘটেছে। সামগ্রিক বিবেচনায় এগুলো ছোটখাটো ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। উপসংহারে আমরা বলতে পারি, চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাচনী আচরণ সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক ছিল বলে মনে করেন?
মুনীরা খান : স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের সামাজিক বন্ধন থাকে। একই সমাজে বসবাস করতে হয় তাঁদের। ফলে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এর কিছুটা পার্থক্য আছে। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে যেমন সুপরিবর্তন এসেছে, ভোটারদের মধ্যেও এসেছে। প্রায় সবার মধ্যে হার-জিতের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রচারকাজ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন, প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বীকে আক্রমণ করে প্রচার চালাননি। নীতি ও লক্ষ্যকে সামনে তুলে ধরেছেন। সাবেক মেয়ররা তাঁদের উন্নয়নমূলক কাজের পরিসংখ্যান উপস্থাপনে বেশি উৎসাহী ছিলেন। আবার তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পর্কে বেশি সজাগ ছিলেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ না হলে সহিংসতা সৃষ্টির আশঙ্কা কমে আসে। সেটাই হয়েছে এবার।
কালের কণ্ঠ : বিজয়ীকে বিজিতের অভিনন্দন ও বিজিতকে বিজয়ীর মিষ্টিমুখ করানোর দৃশ্যও দেখেছি আমরা।
মুনীরা খান : এটা সামাজিক পরিবর্তন। গণতন্ত্রের পথে আরেক ধাপ উন্নয়ন হিসেবে উল্লেখ করা যায়। আসলে প্রার্থীরা ভোটারদের কথা চিন্তা করেছেন। তাঁরা ভোটারদের সম্মান জানিয়েছেন। উভয় পক্ষই জানে, তাদের আচরণ যদি খারাপ হয়, তাহলে পরবর্তীকালে ভোটাররা এটা স্বাভাবিকভাবে নেবে না। অভিনন্দন জানানো কিংবা ফুল দেওয়ার মাধ্যমে পরাজিত প্রার্থীও জনরায়কে শ্রদ্ধা জানানোর কাজটি করেছেন। এতে ভোটারদের সম্মানিত করার মাধ্যমে নিজেরাও সম্মানিত হয়েছেন।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচনকালীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা হয়। দুর্বলতাগুলো কিভাবে কাটানো সম্ভব?
মুনীরা খান : এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী হতে হবে। নির্বাচন কমিশনের যে বিধি-বিধান আছে, সেগুলো কঠোরভাবে পালন করার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। নির্বাচন কমিশনের দক্ষতার ওপর নির্বাচনকালীন প্রশাসনের কার্যক্রম নির্ভর করে। নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হবে, ততই নির্বাচনকালীন প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারবে। নির্বাচনকালে প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকে। এখন একজন যদি মনে করে, ডিসি প্রভাবশালী কর্মকর্তা তাঁকে এমন কিছু বলা যাবে না, যাতে তিনি মনঃক্ষুণ্ন হতে পারেন, তাহলে কিভাবে হবে? নির্বাচন কমিশনকে কর্তৃত্ব করার মতো মানসিকতা রাখতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত হিসেবে কী কী উপাদান থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
মুনীরা খান : প্রশাসনের বিষয়টা বলেছি। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি। ভারতে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে সে দেশে। নির্বাচন চলাকালে কোনো মন্ত্রীকেও সার্কিট হাউস ব্যবহার করতে দেয় না তারা। সেখানে প্রত্যেক প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টের আলাদা ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করতে হয়। মাইকিং থেকে পোস্টার, সব কিছুর ভাউচার সংরক্ষণ করতে হয়। সেটা আবার নিরীক্ষা করেন অন্য রাজ্য থেকে আসা অডিটররা। আমাদের এখানে প্রার্থীর ব্যয়ের হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রে ওই পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। লেভেল প্লেয়িংয়ের জন্য অর্থ ব্যয়ের পথ নিয়ন্ত্রণ হওয়া প্রয়োজন। তার পরও সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে- ১. বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলা; ২. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা; ৩. অবৈধ অর্থের ব্যবহার যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা; ৪. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করা এবং ৫. জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হিসেবে গণ্য হবে।
কালের কণ্ঠ : ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য আর কী পদক্ষেপ নিতে হবে?
মুনীরা খান : ভোট কারচুপির জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা। কিংবা ব্যালট বাক্সে ব্যালট অবৈধভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া। শোনা যায়, বুথে না গিয়েই কোনো কোনো প্রার্থীর কর্মীরা ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। মোটরসাইকেল চলাচল এবারও বন্ধ ছিল, এটা কঠোরভাবে পালন করতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরো সহনশীল হতে হবে। জনসচেতনতার কথা আবারও বলব। একজন ভোটার ব্যালট নেওয়ার সময়ই নজর দিতে হবে, ব্যালটটি যথাযথভাবে সিল ও স্বাক্ষরযুক্ত কি না। অসহনশীল পরিস্থিতি যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে প্রত্যেক প্রার্থীকে সচেতন থাকতে হবে। একজন প্রার্থীকে মনে রাখতে হবে, কোনো কারণে একজন ভোটার ভোট না দিয়ে যদি চলে যায়, তাহলে প্রার্থীরা ভোট পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবের। আবারও বলব, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পর্যবেক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি ভোট কারচুপি রোধ করতে বড় ভূমিকা রাখে।
কালের কণ্ঠ : স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো মোটামুটি নিরপেক্ষ হয়েছে, এটা সব মহলই স্বীকার করে। আপনি কি মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনেও এর প্রতিফলন ঘটবে?
মুনীরা খান : সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার যে উদাহরণ তৈরি হয়েছে, সেটা যে আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না, এটা বলা ঠিক হবে না। কিছুটা প্রভাবিত করতে পারে। তার পরও দুটি নির্বাচনের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তাও আমাদের হিসাবে আনতে হবে। ভোটাররা মনে করতে পারে, আমার ভোট আমি দেব, এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও প্রভাব পড়েছে দুভাবে। যেমন সরকার বলছে, তাদের শাসনামলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। বিরোধী দল বলছে, সরকারের ব্যর্থতারই ফল এই নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে। এই দুই ভাবনা উভয় পক্ষই কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে। সরকার চাইবে তাদের ব্যর্থতাগুলো কাটিয়ে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করতে আর বিরোধী দল চাইবে নির্বাচনের এই ফল তাদের পক্ষে কাজে লাগাতে। সামনে আরো ছয় মাসের বেশি সময় বাকি আছে। এ সময়ের মধ্যে কী হয়, তা এখনই বলা যায় না। আগামী নির্বাচনে কী হবে সে বিষয়ে দলগুলোর ইশতেহারও প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। যেমন আগের জাতীয় নির্বাচনকালে বর্তমান সরকারি দলের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ ছিল, জনগণ তা গ্রহণ করেছে। ভোটাররা কিন্তু এখন শিক্ষিত। তারা বিবেচনা করে সমর্থন দেবে। কম-বেশি চেতনা তৈরি হতে শুরু করেছে মানুষের মধ্যে। তাদের অনেকেই মনে করছে, আমি যেমন প্রার্থী পছন্দ করব, তেমন কাজই তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে পাব।
কালের কণ্ঠ : সব সরকার আমলেই বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে অপব্যবহার করার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এ অভিযোগ থেকে কিভাবে মুক্তি আসতে পারে?
মুনীরা খান : প্রশাসন সরকারের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করে। তাই নির্বাচনকালীন সরকার, সেটা তত্ত্বাবধায়ক হোক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন হোক, সেই সরকার যেভাবে চাইবে সেভাবেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় প্রশাসন। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার যদি অবৈধ কিছু করতে চায়, তাহলে জনগণ সেটা দেখবে কি না। আর দেখলেও তারা সেটার প্রতিবাদ করবে কি না। এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে জনসচেতনতা। সচেতন মানুষ প্রশাসনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে দেবে না। প্রশাসনকে যথেচ্ছ ব্যবহারে এখন কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। যেমন আমাদের দেশে মিডিয়া যেভাবে ব্যাপকতর হয়েছে, এ মুহূর্তে বড় কিছু করে ফেলা সত্যিই কঠিন। আমরা আগে দেখেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ডিসিদের বদলি করে দিল। আচ্ছা বলুন, ডিসিরা কি ভোট কারচুপি করেন? সবটাই নির্ভর করে রাজনৈতিক শক্তির ওপর। রাজনৈতিক দলগুলো যদি স্বচ্ছ থাকে তাহলে প্রশাসন সেদিকে নজর দেবে না। তারা যদি অপব্যবহার না করে তাহলে প্রশাসন ব্যবহৃত হবে কিভাবে?
কালের কণ্ঠ : নির্বাচনে শক্তি ও অর্থের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়?
মুনীরা খান : জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা যদি অর্থের মানদণ্ডে বিবেচ্য হয়, তাহলে রাজনীতি আর থাকে কই? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হতে হলে এটা পরিত্যাগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কঠোরভাবে আরপিও মেনে চলা প্রয়োজন। যেমন একজনকে একটি দলে টানার তিন বছরের কম সময় সদস্য হিসেবে না থাকলে তার প্রার্থী হওয়ার যে বিধান আছে, তা মানতে হবে। সঠিকভাবে মেনে নিলে মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ হতে পারে। নির্বাচন কমিশনকে আরো কঠোর হতে হবে। এখন তারা যদি নির্বাচনকালেই পর্যবেক্ষণ করে তাহলে কিভাবে হবে? প্রি-মনিটর করতে হবে। সম্ভাব্য সব প্রার্থীর প্রতি নজর রাখতে হবে। নির্বাচন ব্যয়ের যে সীমা নির্ধারণ করা আছে, সেটা যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেটা বাড়াতে হবে। এখন একটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও ৫-১০ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। নির্বাচনী এজেন্টের নামে হিসাব খোলার বিধান রাখতে হবে। ভারতের মতো নির্বাচনী ব্যয় অডিট করার ব্যবস্থা করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : নূ্যনতম ব্যয় নির্ধারণে আপনাদের কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে কি?
মুনীরা খান : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এখন প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষে আগের নির্ধারিত ব্যয়সীমা ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। একসময় বলা হতো, ভোটারপ্রতি পাঁচ টাকা ব্যয় নির্ধারণ যথেষ্ট। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, ভোটার প্রতি এই ব্যয়সীমা ৫০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা যেতে পারে। এখানেও নির্বাচন কমিশনের কঠোর নজরদারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। বাংলাদেশে কি এর ব্যবহার আদৌ সম্ভব নয়?
মুনীরা খান : এ বিষয়ে আমি আগেও কয়েক জায়গায় বলেছি। আসলে ইভিএম ব্যবহার আমাদের এখানে খুব একটা ভালো ফল দেবে না। ভোট কারচুপি করার মতো সুবিধা ইভিএমে রয়েছে। কেউ চাইলে সেটা করা সম্ভব। অন্যদিকে যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে নির্বাচনী কার্যক্রম বিঘি্নত হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। ভোট দিতে এসে কেউ যদি যান্ত্রিক কারণে ভোট দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গোলযোগ হতে পারে। সুযোগটা কেউ না কেউ নিতে চেষ্টা করবে। আমার কথা হলো, আমি যেহেতু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই, তাই আমি সেই সুযোগটা তৈরি করে দেব কেন? এবারও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি করে কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে কিছু সমস্যা দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশন তা উপলব্ধি করেছে। খুশির কথা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা জাতীয় নির্বাচনে আর ইভিএম ব্যবহার করবে না। আসলে ব্যালট মাধ্যমে সিল মেরে ভোট দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের মানসিক তৃপ্তিও আছে। একজন ভোটার নিজ হাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছে- এটা সে উপলব্ধি করতে পারে। নিজের চোখে দেখতে পায় পছন্দের মার্কাটিতে সিল মারতে পেরেছে। এটা এক ধরনের মানসিক ব্যাপার। সুতরাং একে বাধা দিয়ে লাভ কী?
কালের কণ্ঠ : নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন ওঠে। আপনার মন্তব্য কী?
মুনীরা খান : নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা অপরিহার্য। আর এ জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন বাজেটে তার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ। তার নিজস্ব সচিবালয় না থাকলে সে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাখার কোনো কৌশলই কাম্য নয়।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই বলা হচ্ছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি অপরিহার্য বলে মনে করেন?
মুনীরা খান : গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বেশি দিন চলে না। গণতান্ত্রিকভাবে আমরা একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করি। সেই সরকারকে আমরা পাঁচ বছরের জন্য বিশ্বাস করি। কিন্তু নির্বাচন চলাকালে তাকে আর আস্থায় রাখতে পারি না। তার পরও বিষয়টি রাজনীতিসংশ্লিষ্ট। একটা বিষয় হচ্ছে, আস্থায় থাকা না থাকা নির্ভর করে সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর। বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আস্থা স্থায়ী করা যায় না। তবে আমি মনে করি, আমাদের দেশে যে বড় দুটি দল আছে, তাদের শিকড় তৃণমূল পর্যায়ে। তাদের ক্ষমতা অনেক। প্রত্যেকেরই খবর রাখার ক্ষমতা আছে। সরকারের তো প্রশাসনযন্ত্র ছাড়াও অনেক মাধ্যম থাকে। সবাই তৃণমূলের চাহিদা ও মনোভাব সম্পর্কে জানতে পারে। জনচাহিদা নিরূপণ করা যেহেতু সম্ভব, তাই সেটা চালিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সবচেয়ে আগে প্রয়োজন উভয় পক্ষের এ বিষয়ে সমঝোতায় আসা। আমরা উভয় জোটের নেতাদেরই আস্থায় এনেছি। তাঁদের প্রতি বিশ্বাসও আছে। সুতরাং তাঁরা সম্মিলিতভাবে ঠিক করুন কোন পদ্ধতি থাকবে।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়েও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে বিতর্ক হয়। নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়া পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি?
মুনীরা খান : নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। বাংলাদেশে এটা ভালো উদ্যোগ। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে অন্তত দুজন মহিলা থাকা উচিত। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে তেমন আপত্তি এখনো দেখা যায়নি। যেটুকু বলা হয়, আমার মনে হয়, সেটা রাজনৈতিক।
কালের কণ্ঠ : সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পর্যবেক্ষক কতটা ভূমিকা পালন করতে পারে?
মুনীরা খান : পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জরুরি বলে মনে করি। নির্বাচনকালে পর্যবেক্ষকদের মুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে পর্যবেক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেওয়া দরকার। প্রয়োজনে পরিচিতিপত্র ব্যবহারকে স্বচ্ছ করা হোক। পর্যবেক্ষকদের নূ্যনতম বয়স ২০ বছর করা প্রয়োজন। কারণ এই বয়সের মানুষই প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সময় দিতে পারে বেশি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
মুনীরা খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.