সংসদে অশালীন বক্তব্য চায় না কোনো দলই

সংসদে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া বন্ধ হোক সেটা চাচ্ছে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েই। অশালীন বক্তব্যের বিষয়ে গত সোমবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেন অনেক সদস্য।
অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ও অসংসদীয় শব্দ ব্যবহার বন্ধে দায়ী সংসদ সদস্যদের সংসদ থেকে বহিষ্কারের দাবির পাশাপাশি এ ধরনের বক্তব্য এড়াতে কমিটি গঠনের প্রস্তাবও দেন তাঁরা। একই সঙ্গে তাঁরা আপত্তিকর বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ না করার আহবান জানান। এ সময় স্পিকারের উদ্দেশে সরকারি দলের এক সদস্য বলেন, জনগণের করের টাকায় সংসদ পরিচালিত হচ্ছে। সংসদ চললে প্রতি মিনিটে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। তাই যাঁরা এসব অসংসদীয়, অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন, তাঁদের বেতন থেকে প্রতিটি শব্দের জন্য ৩০ হাজার টাকা কর্তন করুন।
অশালীন বক্তব্য বন্ধে এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে বিরোধী দল বিএনপি। গতকাল মঙ্গলবার দলের সিনিয়র নেতা সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এক অনুষ্ঠানে বিএনপিকে রুচিশীল দল উল্লেখ করে বলেন, সংসদে অশালীন বক্তব্য বন্ধে জরিমানার প্রস্তাবকে বিএনপি সমর্থন করে। আশা করি এরপর সংসদে অশালীন বক্তব্য আর কেউ দেবেন না।
গত কয়েক দিন সংসদ অধিবেশনে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা পরস্পরকে আক্রমণ করতে আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ সংসদ সদস্যদের নাম উল্লেখ করে আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়া হয়। এ নিয়ে অধিবেশন দফায় দফায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শুধু সংসদের ভেতরেই নয়, সংসদের বাইরেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সম্প্রতি বিরোধী দলের সংসদ সদস্য রেহেনা আক্তার রানু, সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়া, শাম্মী আখতার এবং সরকারি দলের নাজমা আক্তার, অপু উকিল, ফজিলাতুন নেছা বাপ্পীর পাল্টাপাল্টি আক্রমণাÍক বক্তব্য সংসদে উত্তাপ ছড়ায়। অধিবেশন চলাকালে এ ধরনের ‘অশালীন’ ভাষা বন্ধে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে রুলিংও দিতে হয়। তাতে কাজ না হওয়ায় রবিবার রানুর মাইক বন্ধ করে দেন স্পিকার।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গত সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট পর অধিবেশন শুরু হয়। দুপুরে সংসদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী। সংসদে কার্যপ্রণালী বিধির ২৭৪ ধারা অনুযায়ী ব্যক্তিগত কৈফিয়ত দিতে দাঁড়িয়ে অশালীন শব্দের ব্যবহার বন্ধে জরিমানার দাবি জানান সরকারি দলের তরুণ সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলক। বিজেপির সদস্য আন্দালিব রহমান পার্থও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। এরপর প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের আবদুল মতিন খসরু, বজলুল হক হারুন ও মীর শওকত আলী বাদশা, জাসদের মইন উদ্দিন খান বাদল ও বিএনপির আবুল খায়ের ভূঁইয়া অসংসদীয় ভাষা প্রয়োগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে স্পিকারের প্রতি আহবান জানান।
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘সারা দেশ আজ ধিক ধিক করছে। সংসদে আমরা এ কী শুনছি। বঙ্গবন্ধুর পিতাকে নিয়েও গালিগালাজ হচ্ছে। আমাদের তা শুনতে হচ্ছে? আমার ছেলে টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়েছে। সে এসব কথা শুনতে চায় না। সংসদের এই আলোচনা আমাদের সন্তানরা শুনবে এটা আমরা ভাবতে পারি না।’ তিনি বলেন, এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। সরকারি দলের সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘বিরোধী দলের কতিপয় নারী সদস্যের অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জবাব দিতে দিতে আমরা সরকারের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছি। সংসদ সদস্য পদ রক্ষায় সংসদে এসে কৌশল হিসেবে তারা এ ধরনের বক্তব্য রাখছেন। অথচ তাঁদের কারো অনুপস্থিতি ৮৯ দিন, কারো ৮৫ বা ৮৬ এবং গড়ে ৮৩ কার্যদিবস হয়েছিল।’ তিনি বলেন, তাঁদের অসংসদীয় ভাষার কারণে দেশের রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। এটা সংসদের জন্য অবমাননাকর এবং মানহানিকর। মাত্র দুই-তিনজন সদস্যের জন্য ৩৫০ এমপি এর দায় বহন করতে পারেন না। তিনি আরো বলেন, এসব অসংসদীয় ভাষা এক্সপাঞ্জ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সুনাম যা ক্ষুণ্ম হওয়ার তা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি সংবাদমাধ্যমে অশ্লীল বক্তব্যগুলো প্রথম ও শেষ পাতায় ফলাও করে প্রকাশ করা হচ্ছে। স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরো বলেন, জনগণের করের টাকায় সংসদ পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি মিনিট সংসদ চললে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। তাই যারা এসব অসংসদীয়, অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন তাঁদের কাছ থেকে প্রতিটি শব্দের জন্য ৩০ হাজার টাকা বেতন থেকে কর্তন করুন। তিনি অসংসদীয় ভাষা ব্যবহারকারীদের একদিনের জন্য সংসদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান।
এর আগে বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘আল্লাহ ও রাসুলের অসীম রহমতে বাবা-মায়ের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীতে এসেছি। অথচ মরহুম বাবা-মাকে নিয়ে বক্তব্য দেওয়া হয়। বাবা-মায়েরা কী অপরাধ করেছেন?’ তিনি বলেন, সরকারি ও বিরোধী দলের শীর্ষ প্রধানদের বাবা, মা ও সন্তান এবং পরিবার নিয়ে যেভাবে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে এ সংসদে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্পিকারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলেও দাবি করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে ফ্রি থিংকারস ফোরাম আয়োজিত নারায়ণগঞ্জে ভারতীয় কনটেইনার টারমিনাল : কার স্বার্থে? শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘অনেক দিন পর আমরা সংসদে গেলেও শুরু থেকে সংসদ কার্যকর রাখার কথা বলেছিলাম এবং সে জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে স্পিকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিলাম। কিন্তু স্পিকারের ভালো একটি রুলিংয়ের পরও সরকারি দলের এমপিরা আমাদের দলের নেতাদের কটূক্তি করে বক্তব্য দিচ্ছেন। তাঁরা পারলে আমরা কেন বক্তব্য দিতে পারব না। সংসদে কয়েক দিন ধরে এসব ঘটনা ঘটছে। এভাবে অশালীন বক্তব্য দেওয়া আমাদের জন্য লজ্জাকর। কিন্তু এখন সরকারি দলের একজন অশালীন বক্তব্যের জন্য ৩০ হাজার টাকা জরিমানার যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা আমরা সমর্থন করি।’ সরকারি দলের সদস্যরা যেহেতু জরিমানার প্রস্তাব দিয়েছেন, সেহেতু তাঁরাও শালীনতা বজায় রেখেই কথা বলবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএফইউজের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সহসভাপতি ফারুক আহমেদ, সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফেরদৌসী আখতার ওয়াহিদা, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, স্বাধীনতা ফোরামের সভাপতি আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, ফ্রি থিংকারস ফোরামের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.