গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন-জাহাঙ্গীর ও জাপা আজমতের কাঁটা by হায়দার আলী ও শরীফ আহ্মেদ শামীম

সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও জাহাঙ্গীর-সংকট পিছু ছাড়ছে না ১৪ দল সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আজমত উল্লা খানের। তাঁর সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার জাহাঙ্গীর আলম নিজে গণসংযোগে নামলেও তাঁর হাজার হাজার নেতা-কর্মী এখনো হাত গুটিয়ে বসে আছে।
এর ওপর নতুন করে বিষফোড়ার মতো দেখা দিয়েছে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি ইস্যু। কেন্দ্র থেকে কোনো জোটকে সমর্থন না জানালেও স্থানীয় জাপার নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক মান্নানের হয়ে কাজ করছে। তাই আজমত উল্লা খানের সামনে ‘জাহাঙ্গীর’ ও ‘জাতীয় পার্টি’- এ দুই সংকটই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। গতকাল নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটার ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন অবস্থার কথা জানা গেছে।
চান্দনা চৌরাস্তার মসজিদ মার্কেটের মাঠে কথা হয় গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহরিয়ার শহীদ, বিদ্যুৎ ভৌমিক ও ইকরামুল হাসান জিতুর সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে যেভাবে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে আজমত উল্লাকে সমর্থন জানিয়েছেন, তাতে আমরা যা বুঝার ঠিকই বুঝেছি। তাঁর চোখের পানি সাধারণ মানুষ, যুবক বিশেষ করে নারী ভোটারদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। তাঁকে ঘিরে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। ক্ষোভে তাঁর হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক এখনো হাত গুটিয়ে আছে।’ নির্বাচনে তাদের সক্রিয় করা না গেলে জাহাঙ্গীরের চোখের পানিতে আজমত উল্লার বিজয়ের পথ পিচ্ছিল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন এই তরুণ ভোটাররা।
তা ছাড়া প্রার্থী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কতিপয় সিনিয়র নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে যেভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, সাধারণ ভোটাররা তাও ভালো চোখে দেখেননি। কলাপট্টির ফল বিক্রেতা বাদল পালোয়ান বলেন, ‘গরিব মানুষের খোঁজ নেওয়ার নেতা একজনই ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা যে আচরণ করছেন, এটা আমার মতো হাজার হাজার খেটে খাওয়া মানুষ ভোলে নাই। অন্যায়ের জবাব গরিবরা ব্যালটে দেবে।’ এভাবে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, নারী ও তরুণদের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন জাহাঙ্গীর। তাঁর সমর্থকদের ভোট আজমত উল্লার দোয়াত কলমে পড়বে, না জাহাঙ্গীরের আনারস বা অধ্যাপক মান্নানের টেলিভিশনে যাবে- এই নিয়ে নগরজুড়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, অনেকে মুখে স্বীকার না করলেও জাহাঙ্গীর ইস্যুতে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ এখন দ্বিখণ্ডিত। এক গ্রুপে আছেন সুবিধাভোগীরা। অন্য গ্রুপে আছেন সুবিধাবঞ্চিত, ত্যাগীরা। জোট সরকারের আমলে মামলা হামলার শিকার হয়ে কষ্ট করলেও দল ক্ষমতায় আসার পর মূল্যায়ন না পেয়ে হাত গুটিয়ে বসেছিলেন তাঁদের অনেকে। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে আস্থা অর্জন করেন। মেয়র পদে তিনি প্রার্থী হলে তাঁরাই তাঁকে সমর্থন দিয়ে মাঠে নামিয়েছিলেন।
আগামী ৬ জুলাইয়ের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আজমত উল্লার জন্য নতুন করে সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় পার্টি। সমর্থনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও জাতীয় পার্টির স্থানীয় কর্মী-সমর্থকদের অধ্যাপক মান্নানের পক্ষে কাজ করতে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে দলের একটি সূত্রে জানা গেছে। সাড়ে চার বছরের অবমূল্যায়ন এবং সিটি নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের যোগাযোগ না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। গত শনিবার জেলা জাতীয় পার্টির সহসাধারণ সম্পাদক আসাদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাসান উদ্দিন সরকারের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেন। গুঞ্জন উঠেছে, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও মেয়র পদে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাজী মাহমুদ হাসানও শিগগিরই বিএনপিতে যোগ দিয়ে মান্নানের পক্ষে প্রচারে নামছেন। এতে আজমত উল্লার সংকট আরো বেড়ে যেতে পারে। তবে কাজী মাহমুদ হাসান বিএনপিতে যোগদানের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
জাতীয় পার্টির সহযোগী সংগঠন জেলা যুব সংহতির যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় কার্যত এখন আমরা মহাজোটে আছি। কিন্তু ১৪ দল সমর্থিত আজমত উল্লাকে আমরা সমর্থন জানিয়ে ভোট দেব কি না, সে ব্যাপারে এখনো দলে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ তাঁরা এখনো আমাদের এ বিষয়ে ডাকেননি। হয়তো আমাদের প্রয়োজনই নেই। যাঁরা ডাকবেন বা মূল্যায়ন করবেন, কর্মীরা সেদিকেই যাবে- এটাই স্বাভাবিক।’ তিনি স্বীকার করেন, গাজীপুরে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা বিএনপির প্রার্থীর হয়ে কাজ করছে। দল থেকে নিষেধও করা হচ্ছে না।’
জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে খুশি নয়। গত সাড়ে চার বছরে তারা আমাদের কোনো মূল্যায়ন করেনি। চার সিটি করপোরেশনে বিএনপির বিজয়ের পর মানুষ গাজীপুরেও পরিবর্তন চাচ্ছে। এখানে বিএনপির প্রার্থীর পাল্লাও ভারী। তাই ক্ষুব্ধ জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা অধ্যাপক মান্নানের পক্ষেই কাজ করছে। দলীয়ভাবে না হলেও মৌখিকভাবে তাদের মান্নানের জন্য কাজ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু মহাজোটে থেকে এসব কথা আমরা সরাসরি বলতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘আজমত উল্লাকে সমর্থন জানানোর জন্য মহাজোটের শরীক হিসেবে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। এখন পর্যন্ত কেউ ডাকেওনি। তাই কেউ বিএনপির হয়ে কাজ করলে আমরা কিছু বলতেও পারছি না।’
জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব হাজি আবু বকর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মহাজোটে থাকলেও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আমাদের মাহমুদুল হাসান প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে সমর্থন জানিয়েছেন ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থীকে। যতটুকু শুনতে পাচ্ছি, গাজীপুরের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মহাজোট প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে চাচ্ছে না। তারা ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে।’
জাপার আরেক যুগ্ম মহাসচিব ওয়াহিদুজ্জামান সরকার বাদশা বলেন, ‘এখনো আমরা মহাজোটে আছি। কিন্তু তৃণমূল নেতারা ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন দিলে আমাদের অনেক সময় করার কিছু থাকে না। তবে আমাদের নেতা এরশাদ সাহেব যা বলবেন, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সেটাই মেনে নেওয়া উচিত।’
বিএনপিতে যোগদানের বিষয়কে ‘নিছক গুজব’ দাবি করে জেলা জাপার সভাপতি কাজী মাহমুদ হাসান বলেন, দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও টঙ্গীতে দলের গ্রুপিং- এই তিন কারণে তিনি মেয়র পদ থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, ‘জোটের সদস্য হিসেবে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ রাখেনি। ৬৪টি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদের সব কটিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বসানো হয়েছে। ৪৮২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে। সেখানেও আমাদের রাখেনি, যদিও আমাদের কেউ কেউ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছেন। এসব কারণে পার্টির সবাই ক্ষুব্ধ।’ তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগেই আমাদের জোট থেকে বের হয়ে আসা দরকার ছিল। দল থেকে নির্দেশ না দিলেও মূল্যায়নবঞ্চিত ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা গাজীপুরে ১৮ দলের প্রার্থীর হয়ে কাজ করছে। এটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’
তবে অধ্যাপক এম এ মান্নানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী সাবেক এমপি মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার দাবি করে বলেন, ‘মাহমুদ হাসান মনোনয়ন প্রত্যাহারের পর অধ্যাপক মান্নানকে সমর্থন জানিয়েছেন। কিছু সমস্যার কারণে তা সরাসরি বলা যাচ্ছে না। আমরা তাঁকে মাঠে নামানোর চেষ্টা করছি। না পারলেও তাঁরা আওয়ামী লীগের পক্ষে নামবেন না বলে কথা দিয়েছেন।’ মাহমুদ হাসানের বিএনপিতে যোগদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একটা আলোচনা আছে।’
গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ বলেন, ‘প্রকাশ্যে সমর্থন জানানোর পর জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকদের মধ্যে আর কোনো দ্বিধা বা হতাশা নেই। সবাই দল সমর্থিত প্রার্থীর জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে।’ তবে জাতীয় পার্টির সঙ্গে যেটুকু সমন্বয় প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি বলে স্বীকার করেন তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আজমত উল্লার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমম্বয়ক আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, ‘জোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টি আমাদের সঙ্গে আছে। মাহমুদ হাসানের বাসায় গিয়েও একাধিকবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। দলের নেতারা সব ভুলে আমাদের প্রার্থীর জন্য মাঠে নামবেন বলে জানিয়েছেন।’

No comments

Powered by Blogger.