দিল্লি-টাঙ্গাইল-ফরিদপুর--ন্যায়বিচার কতদূর? by এরশাদুল আলম প্রিন্স

২০১২ সালের প্রায় শেষ প্রান্তে ভারত-কন্যার বিদায়ের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ করলো দেশটি। ২৯ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে আসা ভারত-কন্যার লাশকে দেশটি নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা হিসেবেই পেয়েছে। আন্দোলনকারীরা এরকম কথাই বলছে।
তবে যেভাবেই বলা হোক না কেন, ভারতের জন্য এটি অশনি সংকেত! দেশটি ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনকে কীভাবে সামাল দেবে সেটিই ভারতের আজকের বিবেচ্য।
তবে জনগণের জন্য যেটি ভাবার বিষয় তাহলো- ভারত-কন্যারা কি এভাবেই হারিয়ে যাবে আমাদের স্মৃতি থেকে? নাকি তারা শক্তি যোগাবে অসুরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে? রামের দেশে সীতা’রা ন্যায়বিচার পাবে নাকি রাবণেরাই রাজত্ব করবে সেটি ভবিষ্যৎই বলবে। তবে অতি সাম্প্রতিক ও প্রাসঙ্গিক একটা ঘটনা--আসামে এক বিধায়ক ধর্ষণ করতে গিয়ে নারীদের হাতে ঝাঁটা-জুতাপেটা হয়েছেন। কাজেই নারীশক্তির জয় খুব বেশি দূরে নয়। দূর্গার হাতেই তো অসুরবধ হয়েছিল।

যাই হোক, এঘটনার মধ্য দিয়ে ভারত-কন্যা জানিয়ে দিল, ভারত তুমি জেগে ওঠো। ভারত জেগে উঠবে কিনা নাকি জন্ম দেবে আরো অনেক নির্যাতিত ভারত-কন্যার বলা মুশকিল। আমরা শুধু শিক্ষা নিতে পারি জেগে ওঠার।

ভারত-কন্যাকে নিয়ে ভারতের আম-জনতার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-প্রার্থনা-মমত্ববোধ ও মিডিয়ায় যে তোলপাড়-তা খুব সঙ্গত কারণেই আছড়ে পড়েছে আমাদের দেশেও। মিডিয়া কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করেছে বহু আগেই। মিডিয়া মানুষকে মানুষের কাছে নিয়ে এসেছে। ভারত-কন্যা এখন আমাদের বোন।

ধর্ষণের ঘটনা ভারতে নতুন নয়। ধর্ষণসহ নানাবিধ নারী নির্যাতন ভারতে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ভারতের অনেক প্রদেশেই কন্যা সন্তানকে দুর্ভাগ্যের বার্তাবাহক বলে মনে করা হয়। তাই গর্ভের সন্তানটি মেয়ে হলে গর্ভপাতেই তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। তারই প্রমাণ ১৯৯৪ সালের লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাত বিষয়ক আইন। ভারতে গত ২০ বছরে প্রায় এক কোটি মেয়ে সন্তানের ভ্রুণ নষ্ট করা হয়েছে।

কিন্তু আমাদের বোনদের কী অবস্থা? আয়নায় আমাদের চেহারা কি তার থেকে খুব ব্যতিক্রম? হয়তো ভারতের মতো অতোটা প্রকট বা তীব্র নয়। কিন্ত নারীদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি আজও এখানে উপেক্ষিত। আজও আমরা নারীকে ‘মানবমর্যাদা’র দৃষ্টি দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত হতে পারি নি।এখানে লিঙ্গভিত্তিক ভ্রুণ নষ্ট না হলেও কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য কত নারীকে ঘর ছাড়তে হয়েছে এমনকি নিযাতনে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তার হিসেব কে রাখে? 

ভারতের ঘটনাটি যেকোনো কারণেই হোক পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছে। এটাই গুরু্ত্বপূর্ণ। আমাদের মতো দেশগুলোতে জনগণ যতক্ষণ পযন্ত না জেগে ওঠে ততক্ষণ পর্যন্ত সরকার নড়েচেড়ে বসে না। ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য মানুষকে সবসময় আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। আমাদের দেশে এবিষয়টি আরো বেশি। এখানে বেঁচে থাকা যত সহজ ন্যায়বিচার পাওয়া তার চেয়েও কঠিন। এখানে পাঁচশতাধিক লোক লঞ্চডুবিতে মারা গেলেও নৌমন্ত্রীর কোনো শোক-বিবৃতি পাওয়া ভার। রাষ্ট্রীয় উৎকণ্ঠা বা পদত্যাগ তো অনেক পরের কথা। ভারতে খাম্বা চুড়ি হলে গদি টালমাটাল হয়ে য়ায়। আমাদের দেশে ব্রিজ চুরি হলেও গদি ছাড়ার প্রশ্ন নাই। ভারতে রেলের স্লিপার চুরি হলে মিডিয়ায় আগুন জ্বলে। আমাদের পুরো রেল চুরি হলেও মন্ত্রী থাকবেন- মন্ত্রণালয় থাকুক বা না থাকুক।

বড়জোড় ড্রাইভারকে জেরা করা যেতে পারে। এখানে ‘যা কিছু হারায় কেষ্ট বেটাই চোর।’ মন্ত্রী-এমপিরা সাধু।

ঢাকার পুলিশের মতো দিল্লির পুলিশও দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে যথারিতি প্রতিবাদী জনতার ওপর জলকামান দিয়ে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াও হয়েছে। গোলাগুলিও কম হয়নি। সে চেষ্টা সফল হয় নি। জনগণেরই জয় হয়েছে। দিল্লি পুলিশ টুইটারের মাধ্যমে ক্ষমাও চেয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তির বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ অভিনব ব্যবহার অবশ্য আমাদের দেশে এখনো হয়ে ওঠেনি।

দিল্লি গণধর্ষণের শিকার ওই মেয়েটি ১৩ দিন মৃত্যুযন্ত্রণা সয়ে পরাজয় বরণ করে। ভারত সরকার তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ও তাকে সিঙ্গাপুর পাঠায়। আমরা ‘অপরাজিতা’দের বড়জোড় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে পারি।

ঢাকার মতো (সবক্ষেত্রে নয়)দিল্লি পুলিশও ঘটনা ঘটার অনেক পরে ঘটনাস্থলে হাজির হয়। হাজির হয়েই তারা ভিকটিমকে কোথায় পাঠাবে তা নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয় যা আমাদের দেশেও হয়ে থাকে। আমাদের দেশে অপরাধস্থল কোন থানার এখতিয়ারাধীন তা নিয়ে তুলকালাম কম হয় না। এরই মধ্যে লাশ পড়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। আমরা অপরাধস্থলের এখতিয়ার নিয়ে যত চিন্তিত, ন্যায়বিচারের এখতিয়ার নিয়ে ততো চিন্তিত নই।

যাই হোক, দিল্লি পুলিশ জনরোষের চাপে পড়ে পাঁচজনকে আসামি করে চাজশিট দাখিল করে। তাদের মধ্যে একজন আবার ১৮ বছরের নিচে। বলা হচ্ছে, মেয়েটির ওপর সেই বেশি নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হবে মাত্র তিন বছর জেল। তাই আইন সংশোধনের বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। কথা উঠেছে ’অপ্রাপ্ত বয়স’-এর সংজ্ঞা (বয়স) ১৮ থেকে নামিয়ে ১৬ তে আনার।

ভারতে জনগণের পাশাপাশি দেশের আইনজীবী মহলও একাত্মতা প্রকাশ করেছে । তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কোনো আইনজীবীই অভিযুক্তদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াবেন না। কোনো ঘটনায় আইনজীবী সমাজের এ ভূমিকা বিরল। ভারত-বাংলাদেশেতো বটেই।

ভারতে অপরাধীরা নির্যাতন করে মেয়েটিকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখেছে।
আমাদের দেশে কি এরকম ঘটনা ঘটে না?

ভারত-কন্যার লাশ পড়ে ছিল রাস্তার পাশে। আমাদের ‘অপরাজিতা’র লাশও তো পড়ে ছিল রেল লাইনের পাশে। তাতে কী হয়েছে? ভারতের জনগণ দিল্লিগেটে গিয়েছিল বলে কি আমাদের ঢাকা গেটে যেতে হবে?

ভারতের ঘটনাটি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর। টাঙ্গাইলের ঘটনা ৬ ডিসেম্বর। কিন্তু ভারত যখন জেগে উঠেছে, বাংলাদেশ তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যদিও দিল্লির চেয়ে টাঙ্গাইলের ঘটনার নৃশংসতা কোনো অংশেই কম নয়। অপরাজিতার ওপর দৃর্বৃত্তরা পরপর তিনদিন নির্যাতন চালিয়েছে। আরো অবাক করার বিষয় টাঙ্গাইলের ঘটনায় অন্যতম সহায়তাকারী একটি মেয়ে। আর ভারতের ঘটনায় মেয়েটির এক ছেলে বন্ধুও তার সাথে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। দিল্লির জনতা যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে আমরা তো টাঙ্গাইল কিংবা ফরিদপুরের ঘটনায় সে প্রতিক্রিয়া দেখাই নি। বরং আমরাতো সব কিছু ভুলতে বসেছি। ঢাকা-টাঙ্গাইল-দিনাজপুরের মতো আরো অসংখ্য ঘটনা আমাদের জাগিয়ে তুলতে পারে নি।

ভারত চাজশিট দিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। টাঙ্গাইল আসামিদের কেবল রিমান্ডে নিয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল-ফরিদপুর- সব ক্ষেত্রেই আসামি পাঁচ জন।

ফরিদপুরের ঘটনাটি আরো শিউরে ওঠার মতো। বাংলানিউজের খবরে প্রকাশ, ১৩ ডিসেম্বর রাতে চাচাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে নিখোঁজ হয় একটি মেয়ে (নাম প্রকাশ করা হলো না)। পরদিন বাড়ি থেকে আনুমানিক ৫শ’ গজ দূরে মেহগনি বাগানের একটি গাছের ১০/১২ ফুট ওপরে শাড়ি পরা অবস্থায় তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। অবাক করার বিষয়- ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করেন। ওই প্রতিবেদনে মেয়েটিকে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি বলেও উল্লেখ করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা হলে, মেয়েটির লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়না তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। এদিকে, লাশের পুন:ময়না তদন্তের দাবি ওঠার পর থেকেই আসামিরা তার লাশ কবর থেকে তুলে নিতে তৎপর হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী ও তার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু আমরা তো জানি, মেয়েটির লাশের সাথে সাথে আমরা ন্যায়বিচারকেও কবর দিয়েছি। লাশ কবর থেকে তুললেই যে ঢাকায় ন্যায়বিচায় হয় না তার প্রমাণ তো আমাদের হাতে অনেক...।

ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল-দুটো ঘটনাই দিল্লির ঘটনার আগে ঘটে। দিল্লি জেগে উঠেছে। আমরা এখনো শীতনিদ্রায় মগ্ন।

জেগে উঠতে পারিনি বলেই এবার খোদ ঢাকাতেই আমরা জন্ম দিয়েছি ‘নিরুপমার’। নিযাতন করে নিরুপমাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তারই ঘরের বাঁশের আড়ায়। নিজ ঘরেও নিরাপত্তা দিতে পারিনি মিরপুরের ’নিরুপমা’কে। আসলেই এ ঘটনার কোনো উপমা নেই। তাইতো সে নিরুপমা।

জেগে ওঠা মানে শুধু রাস্তায় নামা নয়, জেগে ওঠা মানে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। অন্তত সেপথে অগ্রসর হওয়া। সে পথ থেকে আমরা কতদূর!

বাংলানিউজে আমরা টাঙ্গাইলের মেয়েটির নাম দিয়েছি ‘অপরাজিতা’। বেঁচে থাকাটাই এখানে চরম বিজয়; যেমনটি ও বেঁচে আছে। ঢাকার মেয়টির নাম দিয়েছি ’নিরুপমা’।

কিন্তু আমরা এখনো যারা ঘুমিয়ে আছি তারা নিজেদেরকে কিসের সাথে উপমা দেব?

লেখকঃ দিল্লি-টাঙ্গাইল-ফরিদপুর--ন্যায়বিচার কতদূর? এরশাদুল আলম প্রিন্স, আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক

No comments

Powered by Blogger.