দেশসেরা পাঁচ স্কুলে শিবিরের থাবা by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

ধর্মভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দল ভারী করতে রাজধানীর সেরা পাঁচটি স্কুলকে টার্গেট করে এগোচ্ছে অতি কৌশলে। শুধু মতিঝিল এলাকার স্কুলগুলো থেকেই এক বছরে তিন হাজার ২০ জন কর্মী, সমর্থক তিন হাজার আর চার হাজার বন্ধু যোগ করা হবে।
স্কুলগুলো হচ্ছে- মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মতিঝিল সরকারি বালক কলেজ। এসব স্কুলের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ১০৫ জনকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদও দেওয়া হয়েছে।
স্কুলের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের সদস্য বানাতে গিয়ে 'ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া জীবনের লক্ষ্য নয়- এসব হলে হয়তো পৃথিবীর সুখ পাওয়া যায়, কিন্তু বেহেশত পাওয়া যায় না' বলে প্রচার করছে শিবির। শিশু-কিশোরদের মন জয় করতে দেখাচ্ছে সহজে বেহেশত লাভের লোভও।
শিবিরের গোপন পরিকল্পনার নথি থেকে কালের কণ্ঠ জেনেছে এই তথ্য। নথি ঘেঁটে জানা গেছে, প্রথম ধাপে পাঁচটি স্কুলের পর ধীরে ধীরে রাজধানীর অন্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রচারণা চালিয়ে আরো সদস্য সংগ্রহ করা হবে। প্রথম দফার টার্গেট করা স্কুলগুলো থেকে এ যাবৎ ১০৫ ছাত্রকে বিভিন্ন পদে নেওয়া হয়েছে। তাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে আরো সদস্য। মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে শিবিরের উপশাখা কমিটিতে প্রতিষ্ঠানটির ৪২ জন ছাত্র স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের রয়েছে ১৯ ছাত্র, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২২ ছাত্র, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ২০ ছাত্র রয়েছে। এই পাঁচটি স্কুল নিয়ে শিবিরের একটি সাথি কমিটি করা হয়েছে। এই সাথি কমিটিতে এসব স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণীর ২৫ শিক্ষার্থী রয়েছে। নেতা হওয়ার জন্য এসব খুদে শিক্ষার্থী একটি আবেদন ফরম পূরণ করার পাশাপাশি তারা কেন শিবিরে যোগ দিয়েছে, এর কারণও ব্যাখ্যা করেছে। শিবিরের পরিকল্পনায় রয়েছে, এক বছরে স্কুলগুলোর এসব কমিটির 'দায়িত্বশীল বৈঠক' হবে ৭২টি।
'উদ্দেশ্য ব্যতীত কাজ বৈঠাহীন নৌকার মতো' : নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, মতিঝিল মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিবিরের উপশাখার সেক্রেটারি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তৌফিক আহমেদ। সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে তৌফিক লিখেছে, 'এটি ইসলামী আন্দোলন এবং ব্যক্তির আদর্শ হিসেবে গড়ে ওঠার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য ব্যতীত কাজ বৈঠাহীন নৌকার মতো।'
মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর 'খ-প্রভাতি' শাখার শিক্ষার্থী মোস্তফা নাজমুস সাকিব ওই স্কুলে শিবিরের উপশাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে। সাকিব শিবিরের সরবরাহ করা প্রশ্নের উত্তরে আলাদা কাগজে লিখেছে, 'আমার বেশির ভাগ আত্মীয় এ সংগঠন করে। কিন্তু আমার পরিবার এটা পছন্দ করে না। আমি না জানিয়ে কর্মী হয়েছি। আমি কর্মী, এটা জানার পর অনেক বাধা আসে।' সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাকিব লিখেছে, 'ইসলামী সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। কোনো মানুষের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এ রকম হওয়া উচিত। বেশির ভাগ মানুষের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। কিন্তু এটা আসলে সঠিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নয়। বড় চাকরি করে দুনিয়ায় হয়তো সুখী হওয়া যায়। কিন্তু আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করতে না পারলে বেহেশত লাভ করা সম্ভব নয়।'
একই স্কুলের নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের হোসাইন লিখেছে, 'আমাদের জীবন ধারণ হয়ে গেছে অন্য রকম। আমাদের সমাজ ও আমাদের জীবনের পরিবর্তন সাধিত করতে পারে একমাত্র আল-কোরআন এবং আল-হাদিস। আমাদের সমাজ শয়তানের প্ররোচনায় খারাপ দিকে পরিচালিত হচ্ছে। ওই খারাপ পথ থেকে আমাদের সমাজকে ফিরিয়ে আনতে হলে সকলের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিতে হবে।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিবিরে যুক্ত হওয়ার বিষয় এই শিশু-কিশোররা তাদের পরিবারকে জানায়নি। এমনকি শিবির স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সদস্য করলেও শিক্ষকরা তাদের পরিকল্পনার বিন্দু-বিসর্গও জানেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিবিরের এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ইসলামী ছাত্রশিবির অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো নয়। এ সংগঠন ইসলামের প্রচারে কাজ করে থাকে। ইসলামের কাজ করার জন্য পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী কেন, যেকোনো বয়সের লোককে দাওয়াত দেওয়া ফরজ। এ কাজ করে শিবির কোনো অপরাধও করছে না। উল্লেখ্য, বিভিন্ন কারণে শিবিরের সভাপতি-সম্পাদকসহ বেশির ভাগ নেতাই আত্মগোপনে থাকায় এ ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মতিঝিল মডেল স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর বাবা তাঁর ছেলে শিবিরের খপ্পরে পড়ার খবরে বিস্ময় প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার ছেলেকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছি, শিবির করার জন্য নয়।'
শিক্ষকরা জানেন না : মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম জানান, শিবিরের এমন তৎপরতা সম্পর্কে তিনি জানেন না। মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ হাফিজুল ইসলাম বলেন, 'আমার এখানে শিবির যে এমন কাণ্ড করছে, তা জানি না। এখন অবশ্য সতর্ক হয়ে কাজ করব এবং এগুলো খোঁজ রাখব। কিভাবে এসব ছেলে শিবিরে যুক্ত হলো, তা খতিয়ে দেখা হবে। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রণজিৎ কুমার নাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্কুলের ভেতরে শিবিরের কার্যক্রম নেই। পরিবারের কোনো সদস্য হয়তো শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাঁদের দেখেই বাচ্চারা নাম দিয়েছে।'
অশুভ লক্ষণ : জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, স্কুল পর্যায়ের ছেলেদের এভাবে রাজনীতিতে টেনে আনা শুভ লক্ষণ নয়। এটা রাজনৈতিক উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ। এর ফলে শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে উঠবে। তিনি শিশু শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে বলেন, কোনো সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার আগে সতর্ক হয়ে ভাবতে হবে বিষয়টি আসলে কী? এ ছাড়া শিক্ষক-অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনাও করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তালেবানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শিবির এই অপকর্ম করছে। কোন কোন স্কুলে শিবির এই কিশোরদের ব্রেইন ওয়াশ করছে তার তথ্য গোয়েন্দাদের মাধ্যমে খুঁজে বের করে এনে প্রথম থেকেই শক্ত হাতে দমন করা উচিত। শিবিরের এই অসৎ কাজ এখনই বন্ধ করতে না পারলে দেশটা পাকিস্তান, নয়তো আফগানিস্তান হয়ে যাবে।'
নথি থেকে জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে শিবিরের টার্গেট হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজ, নটর ডেম কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ইতিমধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠানে সদস্য হওয়ার ফরম বিতরণ শুরু করেছে শিবির।

No comments

Powered by Blogger.