হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও খেলাধুলা by মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। পীর আউলিয়ার দেশ এই বাংলাদেশ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেশ এই বাংলাদেশ। এই বাংলায় যুগ যুগ ধরে জন্মগ্রহণ করেছে অনেক কবি সাহিত্যিক ও দার্শনিক।


তাঁদের গান, কবিতা, গল্প আমাদের মনে নতুন আগ্রহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। তাদের লেখনীতে বাংলা সাহিত্য আজ সমৃৃদ্ধিশালী হয়েছে। যে দিকে তাকাই সেদিকেই শুধু দেখতে পাই রূপের খেলা।
এই বাংলার ধন সম্পদ সৌন্দর্যের লোভে এসেছিল পৃথিবীর অনেক জাতি ও গোষ্ঠী। এসেছে ইংরেজ, ডাচ, পুর্তগীজ, আফগান, তুর্কী, ফরাসী, আরবসহ পৃথিবীর অসংখ্য জাতি। তারা এসেছিল বাংলায় নির্দিষ্ট শুল্ক দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করতে। কিন্তু তা না করে তারা বাংলার শাসন ক্ষমতা দিকে মন দেয়। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার চালে ইংরেজরা জয়ী হয়। ইংরেজরা এ উপমহাদেশ শাসন করার আগে গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক জীবন ধারা ছিল এক রকম, আর ইংরেজ শাসন শোষণের পর গ্রাম বাংলার জীবন ধারা হয়ে পড়ে অন্য রকম।
এক সময় বাঙালীর প্রধান খাদ্য ছিল মাছ এবং ভাত। তখন বলা হতো “মাছে ভাতে বাঙালী।” বাংলার ঘরে ঘরে অভাব অনটন কিছুই ছিল না। পুকুর ভরা মাছ গোয়াল ভরা গরু ছিল। মেহমান আসলে তখন দৌড়িয়ে বাজারে যেতে হতো না। পুকুর ভরা মাছ এবং গোয়াল ভরা গাভীর দুধ দিয়ে মেহমানকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হতো। বাঙালীরা বারো মাসে তেরো পার্বণ পালন করে প্রকৃত বাঙালীর পরিচয় দিত। এদেশে প্রাচীনকাল থেকে গ্রামীণ খেলাধুলায় ভরপুর ছিল। হা-ডু-ডু (কাবাডি) ছিল এ দেশের মানুষের খুব প্রাণের খেলা। গ্রামের আনাচে, কানাচে এ খেলা অহরহ চলত। হা-ডু-ডু সঙ্গে ফুটবল খেলাও খুব ধুমধাম ছিল। গ্রামে গ্রামে সংঘ বা সমিতি তৈরি করে এ খেলা খেলত। এক গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রামের খেলার প্রতিযোগিতা হতো। উভয় গ্রামের লোকেরা তখন চাঁদা তুলে ফুটবলের ভাল টিম হায়ার করে আনার জন্য আত্মহারা হয়ে উঠত। যে গ্রামের দল খেলায় জয় লাভ করত তারা কাপ, শীল (ট্রফি) নিয়ে সাত, আট দিন পর্যন্ত আনন্দ ফুর্তি করত এবং গ্রামের ঘরে, ঘরে গিয়ে খেলার ট্রফি দেখিয়ে টাকা পয়সা উপহার নিত। হা-ডু-ডু, ফুটবল ছাড়াও কানামাছি, বউছি, দাঁড়িয়া বাঁধা, গোল্লাছুট, কপালে টিপ, ডাং গুলি, লাটিম, ষাঁড় দৌড়, নৌকাবাইচ, ঘোড়া দৌড়, পুঁথি পড়া প্রভৃতি খুব জনপ্রিয় ছিল। পল্লী গ্রামের মানুষ অত্যন্ত আনন্দ সহকারে এই সব খেলা খেলত। কালের বিবর্তনের ফলে গ্রামের এই জনপ্রিয় খেলাগুলো আজ অবলুপ্তির পথে। বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে বাংলা সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের উচিত এই গ্রামীণ খেলাগুলো যেন হারিয়ে না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখা।
আমি ছোট বেলায় দেখেছি কার্তিক, অগ্রহায়ণ মাসে গ্রাম বাংলার প্রতি ঘরে, ঘরে নবান্নের উৎসবে আত্মহারা হয়ে উঠত। মানুষ তখন আগ্রহ চিত্তে ধান কেটে বাড়িতে তুলছে। কৃষক, কৃষাণির মুখে ছিল হাসি। গোলা ভরা ধান আছে বিধায় সারা বছর ভালভাবে খেতে এবং চলতে কোন অসুবিধা হতো না। মা-কে তখন দেখেছি, অনেক রকমের শীতের পিঠা পায়েশ তৈরি করছে। পুরো শীতকালই আমরা বিভিন্ন রকম পিঠা যেমন- পাটি সাপটা, তৈলের পিঠা, মেরাপিঠা, ভাঁপাপিঠা, ঝালাপিঠা, ফুল পিঠা, পাককন পিঠা, লাড়– পিঠা ইত্যাদি খেতাম। গ্রামের প্রতি বাড়িতে খুব মিল মহব্বত ছিল। আসা-যাওয়া এবং খাওয়া দাওয়া ছিল। গ্রামের মধ্যে বিবাহ সাদি হলে প্রত্যেককে ভাত খাওয়ানোর জন্য দাওয়াত দিতে না পারলেও গ্রামের প্রতি ঘরে গিয়ে রেইপান খাওয়ার দাওয়াত দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। বর্তমানে এই সকল সামাজিকতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে?
শীতকালে গ্রাম বাংলায় জারিগান, সারিগান, কিস্সা, রূপকথার গল্প, যাত্রাগান, পালাগান ইত্যাদিতে ভরপুর ছিল। তখনকার দিনে বেশিরভাগ বিবাহ সাদি শীতকালে সম্পাদন করা হতো। জামাইকে নিয়ে পালকি করে রাতে বিবাহের চলনে যেত। সারা রাত বিবাহের কর্মকা- শেষ করে পরের দিন সকালবেলা বর কনেকে এক সঙ্গে পালকি করে বরের বাড়ি নিয়ে আসত। বরের কনের সঙ্গে কনের মা বরের মাকে সাত পাতিল বিভিন্ন রং বেরঙের নাস্তা দিত। আড়াইয়া, ফি-আড়াইয়া, দাওয়াত শেষ করে জামাইবাবু একটু ফুরসৎ পেতা বেয়াইলা খাওয়া-দাওয়া খুব সুন্দরভাবে সম্পন্ন হতো। এখনকার দিনে কে কোন সময় বিবাহ সম্পাদন করে এবং দেয় তা তেমন শোনা এবং দেখা যায় না। এখন বিজলীর মতো হঠাৎ করে দেখা যায় বিবাহ হচ্ছে এবং দিচ্ছে। সামাজিকতা এখন প্রায় উঠেই গেছে। গ্রাম বাংলার মতো এত মিল মহব্বত খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রামে যেই বাড়িতে বিবাহ হতো সেই বাড়িতে বিবাহের কমপক্ষে ৭/৮ দিন আগে থেকেই বিয়ের সানাই বাজত, পটকা ফুটত। আশপাশের মানুষ তখন জানত এবং শুনত এটি বিয়ে বাড়ি। ঘনিষ্ঠ মেহমানরা বিয়ে বাড়িতে এক সপ্তাহ আগে থেকেই আসত। খুব কাক ডাকা ভোরে উঠে গ্রামের মহিলারা ঢেঁকির মধ্যে ধান ভানত এবং গীত গাইত।
পল্লী জননীর সেই গামছা বাঁধা দই, শালি ধানের চিড়া এবং ভিন্নি ধানের খই এখন আর চোখে পড়ে না। সেই সামাজিকীকরণ এবং বেয়াইলা খাওয়া-দাওয়া আসা যাওয়া লোপ পাচ্ছে। এগুলো ধরে রাখার মতো এখনো কোন সংঘ বা সমিতি তৈরি হয়নি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, “পল্লী গ্রামে শহরের মতো গায়ক, বাদক, নর্তক না থাকলেও তার অভাব নেই। চারদিকে কোকিল, দোয়েল, পাপিয়া, ফিঙে প্রভৃতি পাখির কলগান, নদীর কুল কুল ধ্বনি, পাতার মর্মর শব্দ, শ্যামল শস্যের ভঙ্গিময় হেলাদুলা প্রচুর পরিমাণে শহরের অভাব এখানে পূর্ণ করে দিচ্ছে। পল্লীর মাঠে ঘাটে পল্লীর আলো বাতাসে, পল্লীর প্রত্যেক পরতে, পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে ।
পল্লী মানুষের সেই, গান, সুর, তাল, লয়, কথাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই পল্লী সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রাণ ফিরে পাবে। তাই, আমাদের উচিত পল্লী মায়ের সেইসব উপকথা এবং গানগুলোর জীবন্ত প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া। আমরা যদি উন্নত দেশের মতো পল্লী সাহিত্যকে সংরক্ষণ করার জন্য ঋড়ষশষড়ৎব ঝড়পরবঃু গঠন করে কাজ করি তাহলে এটি সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : শিক্ষক, কোটবাড়ী, কুমিল্লা

No comments

Powered by Blogger.