চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-সংস্কৃতিই লক্ষ্য, রাজনীতি সেই লক্ষ্যে পৌঁছার উপায় by যতীন সরকার

সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে যারা দুটো পৃথক প্রপঞ্চ বলে বিবেচনা করে, আমি তাদের দলে নই। রাজনীতিসহ সব মানবিক কৃতিই সংস্কৃতি। খণ্ড খণ্ড অনেক কৃতির সমবায়েই সৃষ্টি হয় অখণ্ড সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতির কোনো খণ্ডই স্বয়ংসম্পূর্ণ বা অনন্য নয়।


তবে বহুবিধ কৃতির মধ্য দিয়েই মানবিক সংস্কৃতির অভিব্যক্তি ঘটে বলে যেকোনো কৃতিকেই আলাদা করে নিয়েও তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি অবশ্যই দেওয়া যায়। কিন্তু কোনো বিবেচনায়ই কোনো কৃতিকে মূল মানবিক সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে নেওয়া চলে না। তেমনটি করলে সেটি হবে একান্তই ভ্রান্ত বিবেচনা। এ রকম ভ্রান্তি সাধারণত রাজনীতি নিয়েই বেশি করে ঘটে। তাই রাজনীতির কথাটাই বিশেষভাবে বিবেচ্য ও আলোচ্য।
রাজনীতি এমন একটি মানবিক কৃতি, যা অখণ্ড মানবিক সংস্কৃতির অংশ হয়েও এ কৃতি স্বতন্ত্রভাবেই প্রচণ্ড শক্তির ধারক। তাই কোনো জনগোষ্ঠীর মূল সংস্কৃতি যখন বিপন্ন হয়ে পড়ে, তখন সেই বিপন্নতা রোধে রাজনীতিই হয় সেই জনগোষ্ঠীর রক্ষাকবচ। রাজনীতির ওপর ভর করেই সেই জনগোষ্ঠী তার সংস্কৃতি রক্ষা করে, রাজনীতিই তার সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার নিরসন ঘটায়, রাজনীতিই তাকে মূল সংস্কৃতির মন্জিলে পেঁৗছিয়ে দেয়।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাজনীতির এই ভূমিকা মোটেই অগ্রচারীর নয়। রাজনৈতিক সংগ্রাম দিয়েই কোনো জনগোষ্ঠীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয় না। আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গোষ্ঠীগত বা জাতিগত আত্মচেতনার জাগরণ ঘটে সংস্কৃতি-চেতনার মধ্য দিয়ে, সে চেতনাই পরিণতি পায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে। সেই সংগ্রামের সহযোগী হয়েই আসে রাজনীতি।
রাজনীতি সামগ্রিকভাবে মানবিক সংস্কৃতির অংশ হলেও এটি যে একটি বিশেষ 'নীতি'_সে কথাও মানতে হবে। রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়_নীতির রাজা। তবে যুগে যুগেই রাজা তথা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠীর মানুষরা একে নীতিহীন করে তুলেছে, মানবিক কৃতি বা সংস্কৃতিকে বিকৃত করে ফেলেছে। সংস্কৃতি বিকৃত হলেই হয় অপসংস্কৃতি। কর্তৃত্বশীল গোষ্ঠীর হাতে রাজনীতিও বিকৃত হতে হতে প্রতিনিয়ত অপসংস্কৃতির বাহন হয়ে উঠেছে ও উঠছে।
তবে রাজারা কর্তৃত্ববঞ্চিত করে রাখে যাদের, সেই প্রজারা কিন্তু সর্বদা সংস্কৃতির সঙ্গেই লগ্ন হয়ে থাকে। রাজশক্তির সৃষ্ট অপশক্তির ধোঁয়ায় প্রজাদের দৃষ্টিও কখনো কখনো ঝাপসা হয়ে যায় বটে; কিন্তু বেশিক্ষণ বা বেশিদিন তেমনটি থাকে না। আমাদের একান্ত নিকট-অতীতের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলেও ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পাকিস্তান নামক একটি অপরাষ্ট্রের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল। আর সে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল রাজনীতিকদের নেতৃত্বে। রাজনৈতিক নেতারাই আমাদের এই ভূখণ্ডটির স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে ধাপে ধাপে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যান। স্বাধীনতা অর্জনের পর রাজনীতিকরাই দেশটির পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে রাজনীতিকে হটিয়ে দিয়ে দেশে জঙ্গিশাসন কায়েম হলে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সে শাসন অবসিত হয়। এসব দৃষ্টান্ত থেকে মনে হতে পারে যে রাজনীতিই বুঝি সবার ওপর সত্য, রাজনীতিই সর্বসাধ্যসার। এ রকম অবস্থায় রাজনীতির ঊর্ধ্বে বা বাইরে অন্য সব কিছুর অস্তিত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তিই দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে যায়। যেন 'কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়।'
কেশের আড়াল ঘুচিয়ে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তাকালে যে পাহাড়টি চোখে পড়ে, সেটিই সংস্কৃতি। না, এই উপমাটিকে সার্বিক বা নিরঙ্কুশ অর্থে গ্রহণ করা চলবে না। সংস্কৃতি পাহাড়ের মতো অচল-অনড় নয় কোনোমতেই। সংস্কৃতি সদা প্রবহমান ও বর্ধমান। পাহাড়ের উপমাটি ব্যবহার করা হয় এ কারণে যে সংস্কৃতি পাহাড়ের মতোই উচ্চ বিরাট বিস্তৃত।
যেকোনো মানবিক কৃতিরই মূল লক্ষ্য পাহাড়োপম সংস্কৃতি। সেই লক্ষ্যটি থেকে বিচ্যুতি কিংবা সেটির বিকৃতি_কোনোটাই কাঙ্ক্ষিত বা সুফলদায়ক হতে পারে না। ওই অখণ্ড সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিত হওয়াই হতে হবে খণ্ড খণ্ড সব মানবিক কৃতির মূল লক্ষ্য। রাজনীতির মতো মানবিক কৃতির সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। তবে সংস্কৃতির লক্ষ্যবিন্দুতে পেঁৗছানোর ক্ষেত্রে রাজনীতির গুরুত্ব যে অন্য সব মানবিক কৃতির চেয়ে অনেক বেশি, সে কথা মানতেই হবে। এ বিষয়টিকেই প্রখ্যাত হাঙ্গেরীয় দার্শনিক লুকাচ সূত্রায়িত করেছেন এভাবে_'সংস্কৃতিই লক্ষ্য, রাজনীতি সেই লক্ষ্যে পেঁৗছার উপায়।'
লুকাচের সূত্র ধরেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রাম ও তার প্রকৃত তাৎপর্য আমরা বুঝে নিতে পারি। ভাষার ওপর আঘাত হেনেই পাকিস্তানের কর্তৃত্বশীলরা বাঙালিকে তার আপন সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত করে ফেলার মতলব এঁটেছিল। সেই মতলব তারা হাসিল করতে পারেনি এ কারণে যে আমরা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। এই রুখে দাঁড়ানোটা ছিল আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে বিজাতীয় আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করার তাগিদে। এর জন্য আমরা যে সংগ্রামে নেমেছিলাম, সেটি রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল না, ছিল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। এ সংগ্রামের সৈনিকরা সবাই ছিলেন সংস্কৃতি-অঙ্গনের লোক_ছাত্র, শিক্ষক, কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী। আমাদের প্রতিপক্ষের হাতেও সংস্কৃতির হাতিয়ারই ছিল, তবে সেটিকে সংস্কৃতি না বলে বলতে হবে অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতির অবস্থান সর্বদাই সুস্থ মানবিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। মানবতাবিরোধী অপসংস্কৃতির হাতিয়ার দিয়েই পাকিস্তানের শাসকচক্র বাঙালির সমৃদ্ধ ও সচল সংস্কৃতিকে অকর্মা ও অচল করে দেওয়ার অপ্রয়াসে প্রবৃত্ত হয়েছিল। সেই অপপ্রয়াসের প্রথম ধাপই ছিল বাঙালির মাতৃভাষার ওপর আক্রমণ। বাঙালি সঙ্গে সঙ্গেই রক্তের মূল্যে সে আক্রমণ প্রতিহত করে। এর ভেতর দিয়েই জাগ্রত হয় বাঙালির আত্মচেতনা ও সংস্কৃতি-চেতনা। সেই চেতনার অস্ত্র ক্রমেই শানিত হতে থাকে। সেই শানিত অস্ত্র দিয়েই চলে বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। সেই সংগ্রামই চলে বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা বিকৃত করার বিরুদ্ধে, রবীন্দ্র-বর্জন ও নজরুলের খণ্ডীকরণের বিরুদ্ধে, বাঙালিকে তার আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্নকরণের অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে। এই সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ভেতর দিইে বাঙালির জাতীয় চেতনা শক্তপোক্ত হয়ে উঠতে থাকে। এ রকম জাতীয় চেতনা থেকেই বিজাতীয় পাকিস্তানি শাসনের কবলমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকুল আকাঙ্ক্ষা বাঙালিচিত্তে অধিকার বিস্তার করে বসে। মানবিক সংস্কৃতিরই অন্তর্গত এই আকাঙ্ক্ষা। সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই আকাঙ্ক্ষায় যখন একান্ত প্রবণতা সঞ্চারিত হয়ে যায়, তখনই তার বস্তুগত রূপ দিতে এগিয়ে আসতে হয় রাজনীতিকে। বাঙালির মূল সংস্কৃতি ধ্বংস ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতেই সে রাজনীতি স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা তৈরি করে এবং ধাপে ধাপে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তীর্ণ হওয়ার (অর্থাৎ জাতির সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করার) সুষ্ঠু উপায় নির্ধারণ করে। আর এরই একপর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতিকে স্বাধীনতার উপল উপকূলে পেঁৗছিয়ে দেয়। অর্থাৎ বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামের অনুষঙ্গীরূপেই উদ্ভূত হয় তার রাজনীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম।
সংস্কৃতির সংগ্রাম প্রবল গতিবেগসম্পন্ন না হলে এ ভূখণ্ডে পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে সম্পূর্ণ নতুন ধারার রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভ্যুদয় কোনোমতেই ঘটতে পারত না। অনেক রাজনৈতিক নেতাও তো সাংস্কৃতিক সংগ্রামে অংশ নিয়েই রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করেছেন, সংস্কৃতিমানরূপেই রাজনৈতিক সংগ্রামে নিজেদের সংযুক্ত করেছেন, সংস্কৃতিসম্পন্ন রাজনীতি থেকেই উদ্ভূত এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
কিন্তু দুঃখ এই, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি আগের মতো সংস্কৃতির লক্ষ্যাভিসারী ও সংস্কৃতিসম্পন্ন হয়ে থাকল না। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরই আমরা যে রাষ্ট্রীয় সংবিধানটি বিধিবদ্ধ করেছিলাম, তাতে অবশ্য সংস্কৃতি-অভিসারী রাজনীতিরই প্রকাশ ঘটেছিল। আমাদের সামনে সম্ভাবনার একটি দরজা খুলে গিয়েছিল।
অথচ সম্ভাবনার সে দরজাটি অচিরেই বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ করে দিলেন আমাদের রাজনীতিকরাই। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের সেই মর্মান্তিক পটপরিবর্তন ঘটল যাদের হাতে, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণরত সেই ঘৃণ্য ভিলেনদের তো আমরা সবাই চিনি ও জানি। সেই ভিলেন রাজনীতিকরা সুস্থ রাজনীতি হটিয়ে দিয়ে আমাদের সংবিধানটি কেটেকুটে যা করেছে, তাতে আমাদের মহান সংস্কৃতির ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই।
এই দুরবস্থার প্রতিকার রাজনীতি দিয়ে হবে না। আজ প্রয়োজন পাকিস্তান আমলের চেয়েও প্রবলতর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। তেমন আন্দোলনের অনুষঙ্গীরূপেই উদ্ভব ঘটবে নতুন রাজনীতির। কিন্তু তার আগে_এই মুহূর্তেই যথাযথ সাংস্কৃতিক আন্দোলনটি কেন আমরা গড়ে তুলতে পারছি না?
এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক কথাই বলতে হবে। সেটিই হবে আমাদের পরবর্তী প্রসঙ্গ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ
ঘোষণা : অনিবার্য কারণে আহমদ রফিকের কলাম সাদাকালো প্রকাশিত হলো না। বি.স.

No comments

Powered by Blogger.