আন্তর্জাতিক-দ্বীপ নিয়ে দুর্ভাবনা by মো. মোতাহের হোসেন

জুলাই মাসের ৩ তারিখে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ ক'জন কেবিনেটমন্ত্রীসহ রাশিয়ার পূর্বে এবং জাপানের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত কুনাসিরি দ্বীপ থেকে ঘুরে যান। জাপানের হোক্কাইডো থেকে রাশিয়ার কামচাক্কার মাঝে কুরিল দ্বীপমালায় শ'খানেক দ্বীপ আছে।
১৫ হাজার ৬শ' বর্গকি.মি. আয়তনের এই দ্বীপগুলোতে মাত্র ১৯ হাজার লোকের বাস। সম্পদে সমৃদ্ধ এই দ্বীপগুলোর সবই রাশিয়ার দখলে। এর মধ্য থেকে ৪টি দ্বীপ দীর্ঘদিন ধরে জাপান নিজস্ব বলে দাবি করে আসছে এবং রাশিয়াকে বলছে ফেরত দেওয়ার জন্য। কিন্তু রাশিয়া পাত্তা দিচ্ছে না। কূটনৈতিক তৎপরতাসহ দ্বীপ ফেরত পাওয়ার জন্য জাপান সব রকম চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কুকুর খুব পছন্দ করেন। সপ্তাহ তিনেক আগেও জাপানের নাম করা প্রজাতির এক কুকুর প্লেনের বিজনেস ক্লাসে করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। যে কুকুর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানিরা খেয়ে নাকি প্রায় সবই শেষ করে ফেলেছিল। কুকুর উপহার পাওয়ার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পুতিন একটা সাইবেরিয়ার বিড়াল পাঠাতে চেয়েছেন। সে বিড়াল নাকি কুকুর থেকেও বড়। এই দ্বীপ ফেরত না দেওয়ার কারণে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে এখনও কোনো শান্তি চুক্তি হয়নি। বরং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে।
আগস্ট মাসের ১০ তারিখে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি মাউং বাক তাদের দখলে থাকা 'দোকদো' দ্বীপ থেকে ঘুরে যান। কোরিয়া ও জাপানের মধ্যে অবস্থিত ছোট ছোট ৩৫টি দ্বীপ, ফরাসি ভাষায় 'লিয়ানকোট (সলিটারি) রকস্' ১৯৫২ সালে কোরিয়া দখলে নেয় এবং কিছু স্থাপনা গড়ে তোলে। এ বছরের শেষদিকে কোরিয়া সরকার এই দ্বীপগুলো নিয়ে একটা জিওলজিক্যাল পার্ক গড়ে তুলতে চায়। প্রেসিডেন্ট লি এই দ্বীপে ঘুরে যাওয়ার পাশাপাশি জাপানের বর্তমান সম্রাটকে কোরিয়ার কাছে মাফ চাইতে বলেন। সম্রাটকে কোরিয়ার কাছে মাফ চাইতে বলার পেছনে অনেক ইস্যুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে 'কমফোর্ট উইমেন'। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্য পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু দ্বীপ দখল করে নেওয়ার পর সেখানে সামরিক ঘাঁটি বসায়। এসব ঘাঁটির পাশে জাপানি সৈন্যদের যৌন ক্ষুধা মেটানোর জন্য কমফোর্টর্ স্টেশন গড়ে তোলা হয়। এই কমফোর্ট স্টেশনে জোর করে ধরে এনে যেসব মহিলার ওপর পাশবিক নির্যাতন করা হতো, তাদেরকে কমফোর্ট উইমেন বলা হয়। চীনের গবেষকদের মতে, এই কমফোর্ট উইমেনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার। তাদের বয়স ছিল ৮ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা এবং তাদের ৮০ শতাংশই ছিল চীন ও কোরিয়ান মহিলা। কমফোর্ট উইমেন কাহিনী নিয়ে বই আছে এবং এ বিষয় নিয়ে যুদ্ধের প্রায় পৌনে একশ' বছর পরও পত্রিকায় নানা রকম লেখা আসে।
কোরিয়ানরা যেটাকে 'দোকদো' দ্বীপ বলে জানে, জাপানিদের কাছে সেটা 'তাকেসিমা' নামে পরিচিত। তাকেসিমা দ্বীপকে জাপান তাদের অফিসিয়াল টেরিটোরি মনে করে। দু'দেশের মধ্যে মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং মাঝে মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হলেও এবারের মতো এমন চরম উত্তেজনা আগে কখনও হয়নি। তার মধ্যে আছে রাষ্ট্রদূত ডেকে প্রতিবাদ করা, নিজ দেশের রাষ্ট্রদূত ডেকে পাঠানো, চিঠি লেখা, সে চিঠি গ্রহণ না করে ফেরত দেওয়া, অর্থনৈতিক অবরোধ ইত্যাদি। মালিকানার মীমাংসার জন্য জাপান কোরিয়াকে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে বলছে। কিন্তু কোরিয়া রাজি নয়। কোরিয়া বলছে, এটা তাদের দ্বীপ। এ দ্বীপ নিয়ে কেন আদালতে যেতে হবে!
আগস্টের ১৫ তারিখে চীনের কিছু লোক বিতর্কিত পূর্ব চীন সাগরে ছোট ৫টি দ্বীপের একটিতে এসে নেমে পড়ে। তাইপে থেকে দেড়শ' কি.মি. এবং টোকিও থেকে ২ হাজার ২শ' কি.মি. দূরত্বের এই ৫টি দ্বীপ নিয়ে চলছে নানা রকম খেলা। খেলাই বটে। সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়াকে যদি ওয়ার গেম বলা হয়, তবে এ দ্বীপগুলোর দখলের চেষ্টা নিয়ে দিনের পর দিন যা ঘটছে, তা এক ধরনের গেম বৈকি? বড় কোনো অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে না বটে, কিন্তু সতর্ককরণ গুলি ছোড়া, পাথর নিক্ষেপ, এক দেশের নৌবাহিনীর জাহাজের সঙ্গে অন্য দেশের মাছ ধরা জাহাজের সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতি_ এসব প্রায়ই হচ্ছে। জনবসতিহীন এই দ্বীপের দাবিদার তিন দেশ। জাপান, চীন ও তাইওয়ান। প্রায় ৭শ' বছর আগ থেকে এর দাবি নিয়ে গোলমাল থাকলেও ইদানীং সেটা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, দ্বীপের পাশ দিয়ে গেছে পৃথিবীর অন্যতম বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের পথ। আশপাশের পানিতে আছে মাছ এবং পানির নিচে আছে পর্যাপ্ত গ্যাস ও তেল। স্বভাবতই দ্বীপের নাম এক এক দেশে এক এক রকম। জাপানে বলা হয় ছেনকাকু দ্বীপ। চায়নিজ নাম দাইয়াউ এবং তাইওয়ান বলে তাইয়াউটাই। ১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনীর কাছে জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করার পর ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জাপানে আমেরিকার সামরিক শাসন চালু ছিল। কিন্তু জাপানের সর্বদক্ষিণের প্রদেশ ওকিনাওয়া থেকে যায় আমেরিকার অধীনেই। ছেনকাকু দ্বীপ ওকিনাওয়া প্রদেশের অধীন এবং আমেরিকার সমর্থন থাকার কারণে এই দ্বীপে চীন, তাইওয়ান, হংকং থেকে নিজেদের দ্বীপ দাবি করে একের পর এক লোকজন আসছে। কিন্তু টিকতে পারে না।
জাপানজুড়েই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আমেরিকান সৈন্য ও সামরিক ঘাঁটি আছে। এ সৈন্যদের দ্বারা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে ক'দিন এ দেশের মিডিয়াতে খুব তোলপাড় চলতে থাকে। স্থানীয় লোকজন সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। কিন্তু কাজ হয় না তেমন। ক'দিন আগেও ওসপ্রে নামক এক ধরনের যুদ্ধবিমান জাপানের আমেরিকান ঘাঁটিগুলোতে মোতায়েন করার ব্যাপারে জাপান রাজি হচ্ছিল না। বলছে, ওই বিমান দুর্ঘটনাপ্রবণ। কিন্তু আমেরিকা শোনেনি। ঠিকই মোতায়েন করছে। আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে সামরিক (সিকিউরিটি অব ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট) চুক্তি আছে, সে চুক্তি অনুযায়ী এ দেশে আমেরিকার অনেক সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য জাপান সরকারের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। জাপানের আশপাশের সব দেশের সঙ্গে দ্বীপের মালিকানা নিয়ে হঠাৎ বড় আকারের গোলমাল শুরু হওয়ার পর জাপান থেকে আমেরিকান ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়া ও ওসপ্রে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা নিয়ে পত্রিকায় কোনো সংবাদ আসছে না। জাপানের পত্রপত্রিকায় এখন বড় করে শুধুই দ্বীপ-দ্বন্দ্ব। দ্বীপ নিয়ে মালিকানার দ্বন্দ্ব খুব কঠিন জিনিস। কেউ জানে না_ জিব্রাল্টার, ফক্ল্যান্ড, দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে মালিকানার দ্বন্দ্ব কত দিনে শেষ হবে?
এ মুহূর্তে পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ৮৩ শতাংশে মানুষের স্থাপনা গড়ে উঠেছে অথবা ভোগদখলে চলে এসেছে। বাকি যে ১৭ শতাংশ, তার মধ্যে আছে কিছু মরুভূমি, সুউচ্চ পর্বত, উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ। আছে সাগর। সবার কামনা হওয়া উচিত_ সাগর যেন নীলই থাকে; লাল না হয়।

মো. মোতাহের হোসেন : কলাম লেখক
hm.motahar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.