মমতা ও তার বুমেরাং by টি কে অরুণ

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তর্জন ও গর্জন দুটি পরিণতি পেয়েছে_ প্রথমত, একটি মেরুদণ্ড প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইউপিএ জোটের নিজের প্রজাতি চিনতে পেরেছে; দ্বিতীয়ত, সমাজবাদী পার্টির সামনে সুযোগ এসেছে বেঙ্গল প্যাকেজকে বিশেষ উত্তরপ্রদেশ প্যাকেজে পরিণত করার।


প্রাণিকুলের প্রজাতি বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করার একটি উপায় হচ্ছে মেরুদণ্ড পরীক্ষা করা। এ থেকেই চিহ্নিত করা যায় কোনটি স্তন্যপায়ী, কোনটি পাখি। কিন্তু যখন ইউপিএ জোটের প্রজাতি নির্ধারণের ব্যাপারটি সামনে চলে আসছিল, তখন বিভ্রান্তি দেখা দিত। এটা মাছ, হাঁস, না অন্য কোনো অদ্ভুত প্রাণী বোঝা কষ্ট ছিল। উদ্ধারকর্ত্রী হয়ে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ইউপিএ জোটকে বাধ্য করলেন নিজের মেরুদণ্ড দেখাতে। এটা ঠিক মাছ ও হাঁসের মেরুদণ্ড রয়েছে। কিন্তু আরও সূক্ষ্মভাবে চেনার জন্য সেটা জনসমক্ষে আনা দরকার ছিল।
রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ হলেও আদর্শিকভাবে বামপন্থিদের সঙ্গেই থাকতে হয় মমতাকে। (মূলত রাজ্য রাজনীতির কারণে) তিনি এমন কোনো ইস্যু সমর্থন করতে সাহস পান না, যেটাতে বামপন্থিদের বিরোধিতার সুযোগ রয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক যে কোনো ইস্যুতে তিনি ও তার বিরোধী বামপন্থিরা ঐক্যবদ্ধ। হোক না সেটা জ্বালানি ভর্তুকি কিংবা অর্থনীতিতে বৈদেশিক পুঁজি ও পরামর্শক আনা। মুশকিল হচ্ছে, তৃণমূল ও বামফ্রন্টের রাজনৈতিক স্বার্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তৃণমূল যদি ইউপিএ জোটকে ফেলতে চায়, বামপন্থিরা চায় না। ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রশ্নে মমতা ও বামপন্থিরা নিশ্চিত আলাদা বাক্সে ব্যালট ঢোকাবেন। আবার সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজবাদী পার্টির ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি। ফলে নিশ্চিত থাকা যায়, যাই ঘটুক না কেন, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের টিকে থাকা ঝুঁকির মধ্যে নেই।
এই অঙ্ক থেকেই কংগ্রেস মমতার সঙ্গে বিরোধের পথ বেছে নিয়েছে। এমনকি একটি ফোন না করেও তারা মমতাকে সংস্কার প্রস্তাবের পেছনে লাইন দেওয়ার জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়েছিল। মরিয়া মমতা উল্টো কংগ্রেসকে ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন, যাতে করে নিজের দাবি থেকে পিছিয়ে আসার কোনো একটা অজুহাত তার হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়। কংগ্রেসের উচিত হবে না সেদিকে অগ্রসর হওয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবারিত বদমেজাজ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে, কেন্দ্রীয় সরকার থেকে অনেক দূরে, তাণ্ডব চালাতে থাকুন।
বাস্তবতা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর (যেখানে মমতা বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি দেখাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নাকে খত দিয়ে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থনে বাধ্য হয়েছেন) মমতা এখন কেবল দাঁত বের করে কেবল হাসতেই পারবেন; কামড় দেওয়ার মতো ধার খুইয়ে ফেলেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কংগ্রেসের অপ্রত্যাশিত বিরোধের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হচ্ছেন মুলায়ম সিং যাদব। প্রণব মুখার্জিকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে হাত মিলিয়ে তিনি কংগ্রেসের কাছে অন্যতম ঘনিষ্ঠ এবং মমতার চেয়ে প্রাসঙ্গিক মিত্রে পরিণত হয়েছেন।
এবারও মমতার এসব কাণ্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবেন মুলায়ম সিং যাদব। রাজনীতির দাবায় এই গোড়ার চালে মমতা যদি ব্যর্থ হন, ইউপিএ থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া তার আর উপায় থাকবে না। মুলায়ম সিংয়ের প্রতি জোটের নির্ভরতা আরও বাড়বে। পশ্চিমবঙ্গের বদলে সরকার এখন বিশেষ আর্থিক প্যাকেজটি উত্তরপ্রদেশের দিকেই পাঠাবে।
কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্য কংগ্রেস এখন রেল মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো রাজনীতিক যেমন দীপা দাসমুন্সিকে দিয়ে দিতে পারে। এতে করে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য কেন্দ্র থেকে বাড়তি সহযোগিতা থাকবে না, থাকবে না কেন্দ্রীয় আর্থিক সহায়তা; থাকবে কেবল মুমূর্ষু আদর্শের এক বিপুল বোঝা। যদি দেখা যায়, তিনি তখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটকে সহায়তা করছেন, তাহলে নির্বাচনেও তার জন্য অপেক্ষা করছে এক বুমেরাং।

টি কে অরুণ :টাইমস অব ইন্ডিয়ার অপিনিয়ন এডিটর; বুধবারের অনলাইন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর শেখ রোকন

No comments

Powered by Blogger.