নারী যখন বাসযাত্রী by ঈহিতা জলিল

উনুনে ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে সাংসারিক নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করতে করতে, আর কারও জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎই বেগম রোকেয়ার ‘জাগো গো ভগিনী’ মাথায় চেপে বসল। যতই ভাবছি এখন কাজ করতে হবে, অফিস ধরতে হবে, তবুও মাথা থেকে লাইনটি সর ছিল না। অতঃপর কলম ও খাতা; আমার চিন্তার মিলন ঘটাতে বসে গেলাম।


আমি একজন সাংবাদকর্মী হিসেবে বেশির ভাগ সময় বিকেলের অফিস করি। সময়টা আমার ইচ্ছাতেই নির্বাচন করেছি। আমার অফিস এই সুবিধাটি দিয়েছে। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। একজন কর্মজীবী মা হিসেবে আমাকে সংসার ও অফিসের রুটিন মেলাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। আর যাত্রা যন্ত্রণার কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। আমি প্রায় নয় বছর ধরে নিউমার্কেট/ মতিঝিল-মিরপুর/শ্যামলী রুটের বাসে চলাচল করছি। তাই লেখাটি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই লিখছি।
যখন থেকে বাসে মহিলা সিটের সংখ্যা সংরক্ষিত করা হয়েছে সমস্যাটির সূচনা তখন থেকেই ক্রমর্বধমান এবং আজও চলছে। মিনিবাসের বাম পাশের লম্বা আসনটিসহ ডানের ২টি (মোট ৬/৭টি) বা বাসের ডান পাশের নয়টি আসন ‘মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত।’ অতীতে যখন কোন নারী যাত্রী বাসে দাঁড়িয়ে থাকতেন তখন পুরুষ কোন যাত্রী নিজ আসনটি ছেড়ে নারী যাত্রীটিকে বসার সুযোগ করে দিতেন। পরের সময়টাতে কখনও কেউ বসতে দিতেন, কেউবা কটাক্ষ করে বলতেন-‘নারী-পুরুষের তো সমান অধিকার, দাঁড়িয়ে যেতে কেন পারবেন না।’
আর বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পুরুষ যাত্রীরা ধরেই নিয়েছেন পুরো বাসে শুধু ওই নয়টি সংরক্ষিত আসনই শুধু মহিলাদের; আর বাসের বাকি আসনই তাদের (পুরুষদের)। কিন্তু তারা এটি বুঝতে পারছেন না যে ওই আসনগুলো নারী আসন নয়, সেগুলো সংরক্ষিত নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের আসন। প্রতিদিনই পাবলিক বাসগুলোতে এ নিয়ে কোন না কোন নারী ও পুরুষ যাত্রীর মধ্যে বসচা হয়; এর মধ্যে কেউ হন নীরব দর্শক, কেউবা উপভোগ (!) করেন বিনামূল্যে বিনোদন। সেইসব পুরুষ যাত্রীদের বলছি, একবার কি ভেবে দেখেছেন জাতীয় সংসদে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং আরও যারা মহিলা হিসেবে মন্ত্রিত্বের আসনে আসীন তারা কি সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত? উত্তর, অবশ্যই না। বরং, সংসদে সংরক্ষিত আসনের ক্ষেতও শুধুই মহিলাদের। ঠিক তেমনি বাস/মিনিবাসের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসন শুধুই মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, পুরো বাসটিতে মহিলাদের আর অন্য কোথাও বসার অধিকার নেই! এই সহজ-সরল বিষয়টি আমাদের দেশের পুরুষ সমাজে তথা শহরে পুরুষেরা বুঝতে নারাজ।
তবে শুধু পুরুষদেরই একচেটিয়া দোষ দিলে ভুল হবে, অত্যন্ত দুঃখের ও লজ্জার সাথে বলছি, অনেক নারী যাত্রীরাও বাসের ওই মহিলা আসন বিষয়ক বসচায় নারীদের বিরুদ্ধাচরণ করেন। এমনই একটি ঘটনা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি না করে পারছি না। আমি ভাগ্যক্রমে সেদিন একটি আসন পেয়েছি। মাঝপথে একজন নারী ও পুরুষ বাসে উঠলেন, যথারীতি সংরক্ষিত নারী আসনে যে পুরুষ যাত্রীটি বসেছিলেন তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং সদ্য বাসে ওঠা ভদ্রমহিলাকে বসতে দিলেন। কিছুদূর যেতেই অপর একজন মহিলা যাত্রী সদ্য আসন গ্রহণকারী মহিলার পাশ থেকে নেমে গেলেন এবং সদ্য আসন গ্রহণকারী মহিলার সঙ্গের পুরুষটি বসলেন। এর কিছুক্ষণ পর পরবর্তী স্টপেজ থেকে এক মহিলা বাসে উঠলেন। কিন্তু এই ভদ্রলোক(!) আর মহিলা আসনটি ছেড়ে উঠলেন না। যখন ওই ভদ্রলোককে (!) উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাকে বসতে দিতে বললাম এবং সঙ্গে অন্যরাও বললেন, তখন দ্বিগুণ রাগান্বিত হয়ে সেই ভদ্রমহিলা (!) জুড়ে দিলেন। সে নিজেই যে একজন পুরুষ সহযাত্রীর ছেড়ে দেয়া আসনে বসেছেন। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন বলেই ওই পুরুষযাত্রীকে উঠিয়ে বসেছেন সেটি মনে করিয়ে দিলেও তিনি জোর গলায় বলেন সেটি তার ‘যোগ্যতা’। হায় প্রভু এ কেমন ‘যোগ্যতা’? রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আর মনে মনে শুধুই বেগম রোকেয়ার সেই অমর বাণী আওড়াচ্ছিলাম ‘জাগো গো ভগিনী।’
পরিশেষে কিছু কথা না বললেই নয়, সব পুরুষই যে একই রকম মন- মানসিকতার বা একই ধরনের আচরণ করেই তা কিন্তু নয়। চলার পথে এমন অনেকে যারা নারীদের সম্মান করেন, নারীর শারীরিক দুর্বলতাকে হেয় করেন না। যদিও তেমন পুরুষের দেখা মেলে কম, তবুও হয়ত তাদের সংখ্যাই বেশি। নগণ্য যে নয়, এতে কোন সন্দেহ নেই।
আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমার সেই আকাশ সমান ভাবনার একটি উত্তরই আমি প্রতিবার পেয়েছি সেটি হলো পারিবারিক শিক্ষা। একটি ছেলে শিশু যদি পরিবারের নারীদের সম্মানিত হতে দেখে বড় হয়, সম্মান করতে শেখে, সে বাইরে গিয়েও নারীদের সম্মান করবে। একটি শিক্ষিত পরিবার নয়, একটি সচেতন শিক্ষিত পরিবার গড়ে তুলি, যা আমাদের দেবে একটি সচেতন সমাজ এবং একটি সমৃদ্ধশীল দেশ।
লেখক : কর্মজীবী নারী

No comments

Powered by Blogger.