রাজনীতিতে পলায়নে বীরত্ব নেই by স্বদেশ রায়

প্রখ্যাত দুই রাজনীতিক আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি মন্ত্রিসভার সদস্য হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁদের এ কাজকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জামায়াত-বিএনপি জোটের নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম ও তাঁদের জোট।


এছাড়া মিডিয়ায় অনেকে তাঁদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। একজন প্রখ্যাত সম্পাদক নিজ নামে কলাম লিখে তাঁদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী থেকে শুরু করে প্রগতিশীল সম্পাদক সবাই যখন এক কাতারে দাঁড়িয়ে তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, তখন এই স্রোতের চরিত্র বুঝতে পারা সত্যিই কষ্টকর।
জামায়াত-বিএনপি অভিনন্দন জানাবেই। এটা তাদের জন্য সঠিক। কারণ, এই সরকারকে যেখানে যতটুক পারে বিরোধিতা করা বা বিরোধিতা উস্কে দেবার কাজ তারা করবেই। জামায়াত করছে তাদের নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে। অন্যদিকে বিএনপি এখন জামায়াতে ইসলামীর রক্ষাকর্তা। তাই তারাও এ কাজ করবে। বাদবাকি অভিনন্দন যাঁর যাঁর নিজস্ব মতো। তাই তা নিয়ে বলার কিছু নেই। তবে আসলে কী তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন বর্তমানের বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতায় শুধু নয়, যে কোন সময়ের রাজনীতির বাস্তবতায় সঠিক কাজ করেছেন? ধরা যাক এখন আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকার সঙ্কটে আছে। তাদের অবস্থা খারাপ। তা এই খারাপ সময় থেকে উত্তরণের দায়িত্ব কার? নেতার, না অন্য কারও? কেবল যাঁরা সঙ্কটে, বিপদে দায়িত্ব নিতে পারেন তাঁরাই তো নেতা। সুসময়ে দলবেঁধে চলার জন্য তো সাধারণ মানুষ। আর এই কারণেই তো সকলে নেতা হন না। কেউ কেউ নেতা হন। তাহলে সঙ্কটে যারা পলায়নকে শ্রেয় মনে করেন তারা কি নেতা?
রাশেদ খান মেনন বা তোফায়েল আহমেদ বলতে পারেন আমার মতো এক অতিসাধারণ ছা-পোষা সাংবাদিকের কাছে তাঁদের নেতৃত্বের পরীক্ষা দেবার দরকার নেই। ইতিহাস নেতা হিসেবে তাঁদের অবস্থান অনেক আগেই নির্ধারণ করে রেখেছে। ইতিহাস সত্যিই তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননকে নেতা হিসেবে অনেক আগেই স্থান দিয়েছে। তখন তাঁদের দু’জনেরই বয়স পঁচিশের নিচে। কিন্তু একটি যুদ্ধে বিজয়ী বীর ইতিহাসে থাকেন ঠিকই, রাজনীতিতে রাজনীতিক হিসেবে থাকতে গেলে তাকে তো দায়িত্ব নিতে হয়। আর সেই হিসাব যদি একটুখানি মেলানো হয় তাহলে সে চিত্রটি কেমন হবে? তোফায়েল আহমেদের রাজনীতিক জীবনে সব থেকে কঠিন দায়িত্ব নেবার সময় এসেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ ফজলুল হক মনি ঘাতকের হাতে নিহত হবার সঙ্গে সঙ্গে ওই ঘাতকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায় সেদিন ঐতিহাসিকভাবে তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাকের ওপর পড়েছিল। কারণ, তাজউদ্দীন আহমদের তখন দলেও কোন অবস্থানে নেই, সরকারেও নেই। তাই বঙ্গবন্ধু ও শেখ ফজলুল হক মনির মৃত্যুর পরে অনিবার্যভাবে দায়িত্ব পড়েছিল প্রথমত তোফায়েল আহমদের ওপর দ্বিতীয়ত আব্দুর রাজ্জাকের ওপর। তোফায়েল আহমেদ সেদিন ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে সে দায়িত্ব নেননি। সেদিন তোফায়েল আহমেদ এগিয়ে এলে ইতিহাসের চাকা হয়ত অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারত। তাই বস্তুত রাজনৈতিক বীরত্বের বিচারে রাজনৈতিক বীর, ’৬৯-এর মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের মৃত্যু হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে। আব্দুর রাজ্জাকেরও তাই। এর পর থেকে তাদের একটি দেহ বেঁচে ছিল বা আছে। তবে এর পরেও তোফায়েল আহমেদের সামনে আরেকবার বীরত্ব দেখানোর সময় এসেছিল সেটা ১/১১-এর পর। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করার জন্য শেখ হাসিনাকে ন্যক্কারজনকভাবে যেদিন গ্রেফতার করে ওই সময়ে তোফায়েল আহমেদ বীরত্ব দেখাতে পারতেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সকালে যে কাজটি তিনি পারেননি তার কিছুটা হলেও তিনি সেদিন শোধ করতে পারতেন। কিন্তু তোফায়েল আহমেদ সেটা পারেননি। বরং আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ন্যায় তিনি টিভির পর্দায় চোখের পানি ফেলে সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিলেন সামরিকজান্তা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে, যার ভেতর দিয়ে তিনি রাজনৈতিক জীবনে আরও একবার প্রমাণ করেন, তিনি ক্রাইসিসে দায়িত্ব নিতে পারেন না। ঠিক তেমনি এখন আওয়ামী লীগ যে ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে, যার সফল হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কারণ, এবার আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলে বাংলাদেশে সর্বকালের ভয়াবহ পরিকল্পিত গণহত্যা হবে। ১৯৭১-এর চেয়ে অনেক বড় আকারে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- ঘটবে। কারণ, এবার আর কোন বিএনপিও নেই। এবার জামায়াত ও জামায়াত, বিএনপিও জামায়াত। তাই এবার তারা যদি কোনভাবে ফিরে আসার পথ পায় তাহলে ২০০১-এর থেকে এক শ’ গুণ ভয়াবহ হবে বাংলাদেশের অবস্থা। ২০০১’কে এমআর আখতার মুকুল হাবিয়া দোজখের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এবার কী হবে সেটা সত্যি কল্পনার বাইরে, তবে যে কোন দোজখের থেকে খারাপ হবে। তাই এ সময়ে শেষ দিনে, শেষ মুহূর্তেও যদি কোন ভূমিকা কেউ রাখতে পারে সেটা দেশের ও দেশের প্রগতিশীল শক্তির জন্য কল্যাণের। সে দায়িত্ব না নিয়ে বাহবা পাওয়া যাবে এমন বাহবা এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর কাম্য হতে পারে, রাজনীতিবিদের নয়। কারণ, এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী আছেন, যাদের কোন দায়িত্ব নিতে হয় না কেবল বাহবা পেলেই চলে যায়। কিন্তু রাজনীতিবিদ তো কয়লাখনির শ্রমিক, তাঁকে তো সারা হাতে, শরীরে কালি মেখেও সোনা উদ্ধার করতে হয় কয়লার ভেতর থেকে।
আর রাজনীতিতে দায়িত্ব না নিয়ে বাহবা পেলে নিজের লাভ হয়। জনগণের কোন লাভ হয় না। জনগণের লাভের জন্য রাজনীতি করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হয়, ক্ষমতা নিয়ে কাজ করলে তবেই জনগণের জন্য কিছু করা যায়। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মুসলিম লীগের সাপোর্ট হারিয়ে শ্যামা প্রসাদের সঙ্গে জোট করেও ক্ষমতায় থেকেছেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পরে পাকিন্তান সরকারের হোম মিনিস্টারও হয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন, জনগণের জন্য কিছু করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হয়। সরকারের একজন নির্বাহী হতে হয়। আর এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই তিনি, জমিদারী প্রথা উদ্ধার, সরকারী অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার মতো যুগান্তকারী সমাজ পরিবর্তনের কাজ করে যেতে পেরেছেন। আমাদের অনেক প্রগতিশীল হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে বাঁকা চোখে দেখেন। কিন্তু এই পূর্ববাংলাকে কৃষিবাংলা থেকে শিল্পবাংলার দিকে তাঁর স্বল্প ক্ষমতাকালেই নিয়ে যাওয়া হয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে সবাই পাবেন তিনি যে ক’মাস পাকিন্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং আবুল মুনসুর আহমদ শিল্পমন্ত্রী ছিলেন সেই সময়েই নেয়া হয় পূর্ববাংলার বড় বড় শিল্পের পরিকল্পনা, যার অনেক কিছু আইয়ুব খানের সময় বাস্তবায়িত হয়। ওই সময়ে কিন্তু নয় মাসও কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল না সোহ্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ। তারপরেও তারা এ কাজ করে। তাই কম সময়েও যে কাজ করা যায় না তাও কিন্তু সঠিক নয়।
পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু কর্মকর্তা ও মন্ত্রী উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বর্তমান সরকার একটা সঙ্কটে পড়েছে। অন্যদিকে সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকার একটি জালিয়াতি, যা ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে হয়েছে। এই রকম কিছু সঙ্কটে পড়েছে। কিন্তু সরকারের একেবারেই কোন অর্জন নেই তা কি বলা যাবে? এই সরকার বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ৮ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে নিয়ে গেছে। সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের ওপর বিদ্যুত উৎপাদন করছে। অথচ যখন ক্ষমতায় আসে তখন দেশে ২ হাজার ৮শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদিত হতো। সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুত উৎপাদন করছে। অর্থাৎ গত প্রায় ৩৭ বছরে যা হয়নি এই সরকার সাড়ে তিন বছরে সেটা করেছে। অন্যদিকে এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে সে সময়ে দেশে খাদ্যঘাটতি ছিল। আজ যদি সেই খাদ্যঘাটতি থাকত, তাহলে দেশের অবস্থা কী দাঁড়াত। সারাপৃথিবীতে এখন খাদ্যমূল্য যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে চাল আমদানি করতে হলে আজ কত টাকায় এক কেজি চাল কিনতে হতো! এ ছাড়া গ্রামে গ্রামে কর্মসংস্থান, গত তিন বছরে চাকরিসংস্থান, সময়মতো স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই দেয়া কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করা। সর্বোপরি সমুদ্র বিজয়, যা এই সরকার ক্ষমতায় না এলে কখনই হতো না। এসব মিলে অনেক সাফল্য আছে। তিন বছর সময়কালের জন্য যা কম নয়। তাই জাহাজের ইঁদুরের মতো লাফ দিয়ে পড়ার সময় মনে হয় এখনও হয়নি। তাছাড়া ইঁদুর লাফ দিয়ে পড়ে ঠিকই, নাবিককে তো শেষ মুহূর্ত অবধি অবিচল থাকতে হয়।
নাবিকের সেই অবিচলতা দেখাতে ব্যর্থ হলেন ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের নেতা ও ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের নেতা রাশেদ খান মেনন ও তোফায়েল আহমেদ। তবে তোফায়েল আহমেদকে ধন্যবাদ দিতে হবে যে, তিনি ভুল করুন ঠিক করুন কখনও আওয়ামী লীগের বাইরে যান না। যেমনটি দেখা গেছে ভারতের রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জীর। দীর্ঘদিন তাঁকে সাইডলাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু তিনি কংগ্রেস ছেড়ে যাননি। তবে প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে তোফায়েল আহমেদের পার্থক্য হলো, কংগ্রেস ক্রাইসিসে পড়ে যে অবস্থায় প্রণব মুখার্জীকে ডেকেছে তিনি ওই অবস্থায় দায়িত্ব নিয়েছেন। আর দায়িত্ব নিয়ে তিনি সেই ক্রাইসিস থেকে দলকে ও দেশকে রক্ষা করেছেন, যার ফলে তিনি আজ ভারতের রাষ্ট্রপতি আর কংগ্রেসের কাছে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট ম্যানেজার। এর বিপরীতে তোফায়েল আহমেদকে কেউ যদি পলায়নপর এক নেতা হিসেবে কখনও চিহ্নিত করেন তাঁকে দোষ দিতে পারবেন না তোফায়েল আহমেদ।
অন্যদিকে মেননের দায়িত্ব না নেবার বা তাঁর পার্টির দায়িত্ব না নেবার সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করতে গেলে এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। সেটা অনেক বিস্তারিত বিষয়। তবে সাধারণ কথায় বলা যায়, এই উপমহাদেশের কমিউনিস্টদের সব থেকে বড় ব্যর্থতা তারা কখনও দায়িত্ব নেয়নি। এমনকি ভারতের স্বাধীনতায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতায়ও তাদের দায়িত্ব নিতে দ্বিধা তাদেরকে অনেক পিছে ফেলে দেয়। রাষ্ট্রক্ষমতার ক্ষেত্রেও তাদের একই মানসিকতা। জ্যোতি বসু তাঁর আত্মজীবনীতে স্বীকার করে গেছেন তাঁদের যেমন ভুল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজকে সমর্থন করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরে আসা, তেমনি তাঁর পার্টি ভুল করে তাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার সিদ্ধান্ত না দিয়ে। হয়ত ভারতের কমিউনিস্ট নেতা প্রকাশ কারাতকেও একদিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখতে হবে, ভারতে মৌলবাদের উত্থানের বড় কারণ তাঁর নিজের একটি ভুল। কংগ্রেস সরকার থেকে বেরিয়ে আসা তাঁর ভুল ছিল। মেননের দল অবশ্য সে ভুল করেনি। তারা মহাজোটকে আগের মতোই সমর্থন করবে বলে জানিয়েছে। তবে তিনি সরকারে গিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময় ধরে ঢুকে যাওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে কাজটি করতে পারতেন সেটা না করে ভুল করেছেন। মৌলবাদীরা যখন হিংস্র থাবা নিয়ে এগিয়ে আসছে তখন সাময়িক এই বাহবার কোন মূল্য নেই। বরং যতটুকু ভূমি পাওয়া যায় তাই নিয়ে লড়াই করার মানসিকতার ভেতর বীরত্ব থাকে। যতই সাফল্যের সঙ্গে পলায়ন করুন না কেন, সেটা পলায়নই।

No comments

Powered by Blogger.