মন্ত্রিত্বের আহ্বান যথা নিয়মেই হয়েছে ॥ প্রধানমন্ত্রী- মেননের অভিযোগ নাকচ ॥ এবিএম মূসার বক্তব্যের সমালোচনা

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিত্বের আহ্বান নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, যথাযথ নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করেই মন্ত্রিপরিষদ সচিব তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।


গত সরকারের আমলেও যেভাবে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়েছে, এবারও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। ব্রিটিশ, ভারতসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরালের আত্মজীবনীর কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, আইকে গুজরাল নিজেই লিখেছেন যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আমন্ত্রণ পেয়েই তিনি দু’বার মন্ত্রী হয়েছেন। তবে কী ভারত সভ্য দেশ নয়?
সম্প্রতি একটি বেসরকারী টেলিভিশনের টকশোতে সরকারকে চোর ও দুর্নীতিবাজ বলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। এবিএম মূসার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘উনি (এবিএম মূসা) আমার কাছে একটি বেসরকারী টেলিভিশনের লাইসেন্স চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি দিতে পারিনি বা সম্ভব হয়নি। টিভির লাইসেন্স না পাওয়ার শোক ভুলতে পারেননি বলেই উনি আমাদের চোর ও দুর্নীতিবাজ বলতে বলেন।’ তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, উনি (এবিএম মূসা) একটি বেসরকারী টিভি চালানোর টাকা কোত্থেকে পাবেন? তাঁর তো এত টাকা নেই। তবে কি তিনি টিভি চালাতে চুরি করবেন? তাঁর মতো এমন মানুষের মুখ থেকে এসব কথা শুনলে দুঃখ হয়।
বিভিন্ন টকশোতে সরকারের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম দেশে বেসরকারী টেলিভিশনের লাইসেন্স দেয়। এতে আজ দেশে অনেক বেসরকারী টিভি হয়েছে, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন প্রতিদিনই ওসব টেলিভিশনের টকশোতে বসে এমন সব কথা বলেন শুনে অবাক হতে হয়। কারও নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, সাবেক কিছু আমলা আছেন যাঁদের দেখেছি ডিজিএফআইয়ের কাছে উপদেষ্টা হওয়ার জন্য ধর্না দিতে, করুণভাবে তাঁদের কাছে গিয়েছেন কিছু পাওয়ার আশায়- আজ তাঁরাই টকশোসহ বিভিন্নস্থানে নানা তাত্ত্বিক কথা বলছেন। যারা আমাদের নির্দেশে কাজ করেছেন তাঁরাই এখন পথ দেখাতে চান। আমার প্রশ্ন ক্ষমতায় থাকতে তাঁরা কী করেছেন? বিএনপি-জামায়াতের ৫ বছরের লুটপাটের সময়ইবা তাঁরা কী করেছেন? প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতি তাঁদের কথায় কখনও বিভ্রান্ত হবে না। শনিবার সন্ধ্যায় তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বৈঠকে আলোচনার শীর্ষেই ছিল দুই নেতা তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননের মন্ত্রী হিসেবে শপথ না নেয়ার বিষয়টি। রাশেদ খান মেনন সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করলেও প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ প্রসঙ্গে একটি কথাও বলেননি প্রধানমন্ত্রী। শুধু এটুকু বলেন, তাঁরা মন্ত্রিত্ব নিতে চাননি, এটা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও রাশেদ খান মেননের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রের বিভিন্ন উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বিশ্বের যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে, সেসব দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আমন্ত্রণেই নেতারা মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। প্রধানমন্ত্রী যে তালিকা দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সেই অনুযায়ী আমন্ত্রণ জানান। কারণ প্রশাসনিক বিভাগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবই হচ্ছেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান। বাংলাদেশেও মন্ত্রীরা শপথ নেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের আমন্ত্রণ পেয়ে। এবারের মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে অযথা জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা মোটেও কাম্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের শুরুতেই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন দফতর সম্পাদক এ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান। এরপর সাত বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাঁদের স্ব স্ব বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট তুলে ধরেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার ব্যাপারে বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রীও দ্রুত সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে ব্যাপক কর্মতৎপরতা চালানোর নির্দেশ দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের।
জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ ছিল সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। ছিল জঙ্গী ও বাংলা ভাইদের তা-ব। বোমাবাজি, গ্রেনেড হামলা, মানুষ খুন ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। আমরা ক্ষমতায় এসে কঠোরহস্তে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমন করেছি। আর তাই আজ দেশের মানুষ শান্তি ও স্বস্তিতে বসবাস করছে। এখন আর সারাদেশে বোমাবাজি হয় না। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ছাড়া কোন দেশ উন্নতি করতে পারে না। তাই গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্য নিয়েই বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদে রদবদল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি মন্ত্রিসভা রদবদল করেছি। কেউ কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ মন্ত্রিত্ব নিতে চাননি, এটা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি এবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছি। ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে যেভাবে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সময় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, এবারও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। নিয়মের কোথাও কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। রাশেদ খান মেননের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, একজন বললেন সচিবের আহ্বানে মন্ত্রী হওয়া নাকি কোন সভ্য দেশে হয় না! একথা তিনি কোথায় পেলেন? যে নেতা বলেছেন এটা কোন সভ্য দেশে হয় না, তাঁকে বলব আইকে গুজরালের অটো বায়োগ্রাফিটি পড়ে দেখতে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরালের আত্মজীবনের কয়েকটি অংশ পাঠ করে বলেন, ওই আত্মজীবনীতে আইকে গুজরাল নিজেই লিখেছেন যে প্রথমবার মন্ত্রী হয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের আহ্বান পেয়ে। আর দ্বিতীয়বার মন্ত্রী হয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তার আহ্বান পেয়ে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তবে কী ভারত সভ্য দেশ নয়? পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও তো এই নিয়মই অনুসরণ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে প্রথম মন্ত্রিপরিষদ গঠনের দিনই অথবা পরদিন ওই নেতা (রাশেদ খান মেনন) সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নিজেই বলেছেন, ‘আমি তো মন্ত্রী হওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কোন ফোন পাইনি।’ তাঁর এই মন্তব্য তখনকার গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। তিনিই স্বীকার করেছেন, মন্ত্রীর শপথ নিতে হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ফোন পেতে হয়। তিনি বলেন, বর্তমান মহাজোটের বিশাল সংখ্যায় সংসদ সদস্য রয়েছেন। সবাইকে তো আর মন্ত্রী বানানো সম্ভব নয়।
সম্প্রতি হলমার্কসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোন ধরনের ঘটনা ঘটলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা বসে থাকছি না। বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সবসময় বলতেন যে গাছ ফল দেয় সেই গাছে ঢিল পড়ে।’ আমরা জনগণের জন্য কাজ করছি, বিশ্ব মন্দার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের বেশি রাখতে সক্ষম হয়েছি, বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা পুরস্কার পাচ্ছি। গ্রামীণ অর্থনীতি এখন চাঙ্গা। দেশকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছি এবং আমরা দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করছি বলেই আমাদের এত সমালোচনা।
কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের রমজান মাসে ও ঈদে কোন লোডশেডিং ছিল না। আমি সকাল ও বিকেলে দু’ঘণ্টা লোডশেডিং করতে বলেছি যাতে দেশের মানুষ লোডশেডিং শব্দটি ভুলে না যায়, কষ্টের কথা মনে রাখে। যারা আজ কুইক রেন্টাল নিয়ে সমালোচনা করছেন তাঁরা হয়তো চান না আমরা বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করি, মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত দেই। আমরা ক্ষমতায় এসে দ্রুত বিদ্যুত উৎপাদনের ব্যবস্থা না করলে আজ দেশের যে কী দূরবস্থা হতো সবাইকে তা একটু উপলব্ধি করতে বলব।

No comments

Powered by Blogger.