প্লট-ফ্ল্যাট দুটোই নিয়েছেন ২৯ পদস্থ কর্মকর্তা by জাহাঙ্গীর আলম

২৯ জন সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা একই সঙ্গে রাজউকের প্লট ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ থেকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অবশ্য পাঁচজন সাবেক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবও প্লট ও ফ্ল্যাট পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন।


এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিব ও সমমর্যাদার পাঁচজন, যুগ্ম সচিব ও সমমর্যাদার ১০ জন, চারজন উপসচিব এবং একজন সিনিয়র সহকারী সচিব প্লট ও ফ্ল্যাট নিয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত চার সচিব এবং একজন যুগ্ম সচিবও রয়েছেন তালিকায়। লটারি ছাড়াই তাঁদের এসব প্লট ও ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তবে এ ক্ষেত্রে রাজউকের শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। প্লট পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজউকের শর্ত হিসেবে উল্লেখ আছে, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাস্টারপ্ল্যানের আওতাধীন এলাকায় নিজ নামে, স্বামী/স্ত্রী বা পুত্র-কন্যা বা পোষ্যের নামে অথবা বেনামে ইতিপূর্বে রাজউক অথবা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা থেকে কোনো জমি বরাদ্দ/লিজ নেওয়া হয়নি এবং ক্রয়সূত্রে বা উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো আবাসিক জমি/বাড়ি থাকা যাবে না। এ জন্য আবেদনকারীকে হলফনামা দিতে হয়।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, কারোরই একাধিক সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাট নেওয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।
গতকাল রোববার গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া বর্তমান ও সাবেক ২৯ সরকারি কর্মকর্তার তথ্যাদি উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ২৯ কর্মকর্তার মধ্যে পূর্বাচলে ১৩ জন এবং উত্তরা তৃতীয় পর্বে ছয়জন প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। ১০ জনের প্লটসংক্রান্ত কোনো নথি পাওয়া যায়নি। ফ্ল্যাটের মধ্যে লালমাটিয়ায় ২৪ জন এবং একজন মিরপুরে বরাদ্দ নিয়েছেন। চারজনের ফ্ল্যাটসংক্রান্ত কোনো নথি পাওয়া যায়নি।
বৈঠকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান, ওই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা, মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান খান কামাল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট নেওয়া অনৈতিক হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এমনটা না হয়, সে জন্য আইন করা হবে।
পূর্তসচিব খন্দকার শওকত হোসেন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট পেয়েছেন। তিনি আই-৮ লালমাটিয়ায় গৃহায়ণের একটি ফ্ল্যাটও পেয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আমি কোনো অবৈধ সুবিধা নিইনি, নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। তিনি আই-৭ লালমাটিয়ায় একটি ফ্ল্যাটও বরাদ্দ নেন।
জানতে চাইলে মোল্লা ওয়াহেদ বলেন, ‘যখন ফ্ল্যাট পেয়েছি, তখন রাজউকে আমার প্লট ছিল না। যখন রাজউকে প্লটের জন্য আবেদন চাওয়া হয়, তখন এমন কোনো আইনগত বাধা ছিল না যে, যাঁদের ফ্ল্যাট আছে, তাঁরা প্লটের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। প্লট ও ফ্ল্যাট একত্রে থাকা আইনে কোনো বাধা নেই।’ এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশে এ বৈঠক হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় এইচ-৬-এ গৃহায়ণের ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের প্লট পেয়েছি ২০০৫ সালে। আর গৃহায়ণের ফ্ল্যাট পেয়েছি বছর দেড়েক আগে। যেহেতু পূর্বাচল সিটি করপোরেশনের বাইরে, তাই সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেতে আইনি কোনো বাধা নেই।’
অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের মধ্যে এহসানুল ফাত্তাহ উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় আই-৫ ফ্ল্যাট, সাবেক সচিব কামরুল হাসান উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় কে-১৩ ফ্ল্যাট, সাবেক সচিব গোলাম মোস্তাকিম পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় এন-৪ ফ্ল্যাট পেয়েছেন। সাবেক পূর্তসচিব মাহবুবুর রহমান পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় এল-২ ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন।
অতিরিক্ত সচিব এম এইচ ফরহাদ খান পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় এইচ-২ ফ্ল্যাট পেয়েছেন। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল কাইউম পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় এল-৯ ফ্ল্যাট নিয়েছেন। রাজউকের সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম সিকদার উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট এবং মিরপুর-৩-এ-৪ গৃহায়ণের ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন। জীবন বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অতিরিক্ত সচিব পরীক্ষিত দত্ত চৌধুরী পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় জে-১২ ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন। যুগ্ম সচিব সুকুমার চন্দ্র সাহা পূর্বাচলে স্ত্রীর সঙ্গে যৌথ নামে সাড়ে সাত কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় এন-১০ ফ্ল্যাট পেয়েছেন। যুগ্ম সচিব মোরাদ হোসেন পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় এল-৮ ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন।
যুগ্ম সচিব মো. আজহারুল হক পূর্বাচলে পাঁচ কাঠা এবং লালমাটিয়ায় কে-৮ ফ্ল্যাট, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য যুগ্ম সচিব তাজুল ইসলাম চৌধুরী উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় কে-৪ ফ্ল্যাট, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এ এস এম মামুনুর রহমান খলিলী পূর্বাচলে পাঁচ কাঠা এবং লালমাটিয়ায় কে-১১ ফ্ল্যাট, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ফজলে রাব্বী উত্তরায় পাঁচ কাঠার প্লট এবং লালমাটিয়ায় এল-৭ ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন।
এ ছাড়া গতকালের বৈঠকে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট পাওয়া কর্মকর্তাদের যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়, তাতে ব্যাংকিং বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব নেওয়াজ হোসেন চৌধুরী, সড়ক বিভাগের উপসচিব আবদুল মালেক, বেপজার সদস্য আখতারুজ্জামান, সড়ক বিভাগের উপসচিব গোলাম মোস্তফা খান, যুগ্ম সচিব আকতার আহমেদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হাবিবুর রহমান, সড়ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব এম এন সিদ্দিক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিয়াজ উদ্দিন মিঞার প্লটসংক্রান্ত নথি মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। আবার সিলেট বিভাগের কমিশনার এন এম জিয়াউল আলম এবং বিয়ামের মহাপরিচালক ইখতেদার হায়দারের ফ্ল্যাটসংক্রান্ত কোনো নথি মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিব ফেরদৌসি মহসীন এবং যুগ্ম সচিব আনিস উদ্দিন মঞ্জুরের প্লট ও ফ্ল্যাটসংক্রান্ত কোনো নথি পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা কোটায় অন্য ৩০ কর্মকর্তা মিথ্যা হলফনামা দিয়ে রাজউক থেকে দুটি করে প্লট নিয়েছেন। স্বায়ত্তশাসিত কোটায় দুটি প্লট পেয়েছেন আরও ১০ জন। শুধু পূর্বাচল প্রকল্পেই দুটি করে প্লট পেয়েছেন আরও সাতজন। পাঁচ দম্পতি অর্থাৎ স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের প্লট পাওয়ার ঘটনাও আছে। অবশ্য রাজউক তাঁদের প্রত্যেকের একটি করে প্লট বাতিল করে দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.