চারদিক-আমাদের শিশু মুক্তিযোদ্ধারা by কামরুল হাসান ভূঁইয়া

জুলাই মাসের শেষ অথবা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। ২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর মেলাঘরে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মতিন ও ক্যাপ্টেন হায়দার কী নিয়ে যেন আলাপ করছেন। মাঝেমধ্যে বাঁশের তৈরি টেবিলের ওপর ম্যাপশিট পেতে মার্কার দিয়ে আঁকিবুকিও করছেন। আমাকে মেজর খালেদ ডেকে পাঠিয়েছেন, আমি জানি না কেন।

আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু টেলিফোন বেজে উঠল। মেজর খালেদ ফোন ধরলেন। বোধ করি মনোযোগ চলমান আলোচনায় থাকায় তিনি টেলিফোনের আলাপে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। টেলিফোনের অপর প্রান্তে কে আমি জানি না। জানা সম্ভবও ছিল না। কয়েক সেকেন্ডের কথা শুনে খালেদ বললেন, ‘সবাইকে চোখ বেঁধে রেখে দাও।’ (পরে জেনেছি কয়েকজন কিশোর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। গেটে আরপি (Regimental Police) বাধা দেয়। কিশোররা পীড়াপীড়ি করতে থাকে। আরপি হাবিলদার প্রথমে ক্যাপ্টেন হায়দার এবং পরে মেজর মতিনকে টেলিফোন করেন। কাউকে না পেয়ে ছেলেদের অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু ছেলেরা আরপি হাবিলদারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বলে জানা যায়।
এরপর ঘণ্টা দুয়েকের আলোচনা শেষে মেজর খালেদ ক্যাপ্টেন গফফারের সাব-সেক্টর সদর দপ্তর কোনাবন যাবেন। আমাকে বললেন গাড়িতে উঠতে। এম-৩৮ খোলা জিপের পেছনে উঠে বসলাম। গাড়ি মেইন আরপি চেকপোস্ট পার হয়ে ১৫-২০ গজ পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ মেজর খালেদ গাড়ি পেছাতে বললেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় আট-নয়জন ১৪-১৫ বছরের কিশোর। খালেদ আরপি হাবিলদারের কাছে জানতে চাইলেন, কেন এদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। আরপি হাবিলদার বলেন, ‘স্যার, আপনিই তো এদের চোখ বেঁধে রাখতে বলেছেন।’ খালেদের এবার হয়তো মনে পড়ল; আদেশ দিলেন ওদের চোখ খুলে দিতে। জিজ্ঞেস করলেন ওদের, ওরা কী চায়। মুহূর্তের মধ্যে সব কিশোর ক্রোধে মেজর খালেদের ওপর ফেটে পড়ল। ওরা আর্মি চেনে না, ওরা মেজর চেনে না, ওরা সেক্টর কমান্ডার কী জানে না। ওরা শুধু ওদের মাতৃভূমি চেনে। ওরা ওদের মাতৃভূমির ক্রান্তিকালে সহায় হতে এসেছে। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই, ‘আপনি আমাদের চোখ বাঁধার হুকুম দেওয়ার কে? আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে না দিলে আমরা অন্য জায়গায় যুদ্ধ করব। বাংলাদেশ কি একা আপনার?’ খালেদ হাসছেন। এই হাসির অর্থ আছে। এই হাসি আত্মবিশ্বাসের হাসি। এই হাসির অর্থ—এই প্রত্যয়ী জাতির যেভাবেই হোক, যত দিনেই হোক, যুদ্ধে বিজয় অনিবার্য। মেজর খালেদ তখনই ফিল্ড টেলিফোনে ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে কথা বললেন। স্টুডেন্ট কোম্পানি এলাকায় একটি ভালো জায়গায় দুটি ১৮০ পাউন্ড টেন্ট লাগিয়ে এই ছেলেদের দিয়ে তৈরি করতে বললেন ‘ওয়াই প্লাটুন’ (Young Platoon)। ২১ পাউন্ড ওজনের ব্রিটিশ ৩০৩ ব্রাউনিং (এলএমজি) এরা তুলতে পারত না ঠিকই, তার পরও এদের অসাধ্য এমন কিছুই ছিল না। এই ছেলেদের জন্য আলাদা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো। কঠোর সে ট্রেনিং। পরিশ্রান্ত এই ছেলেদের কঠোর প্রশিক্ষণে কোনো আপত্তি নেই, ওরা বরং আগ্রহী। বুক ভরা সাহস ওদের। এ কোনো কথার কথা নয়।
সীমান্ত এলাকা বক্সনগরে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে। ওদের বাংকার, ওদের চলাফেরা দেখা যায়। কয়েক সপ্তাহ পর একদিন দিনের বেলায় মেজর খালেদ ছেলেদের নিয়ে গেলেন সেখানে। এই কিশোরদের তিনি পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের বাংকারগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘যারা আমার সামনে শত্রুর ওই বাংকারগুলোতে গ্রেনেড ছুড়ে আসতে পারবে তাদের জন্য পুরস্কার এই ঘড়ি।’
আমার অন্তরাত্মা নড়ে উঠল। একটি ঘড়ির বিনিময়ে নির্বোধ, নিষ্পাপ কিশোরদের নির্ঘাত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। শত্রু বোকা নয়। তারা প্রশিক্ষিত, সংগঠিত ও অভিজ্ঞ। আমাদের অবুঝ বালকদের তার কিছুই নেই। এই অপারেশন আবার দিনের আলোতে। প্রতিরক্ষা এলাকায় কোনো বেসামরিক ব্যক্তিকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, এটাই সামরিক শিক্ষা। আমাদের ছেলেরা শুধু প্রতিরক্ষা এলাকায়ই প্রবেশ করবে তা নয়, তাদের শত্রুর বাংকার পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে এবং সবাইকে একসঙ্গে। এ ধরনের (দিনের রেইড) অপারেশন কেবল অভিজ্ঞ কমান্ডোদের দ্বারাই সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ছেলেদের কেউ শত্রু প্রতিরক্ষা অবস্থানে মারা গেলে বা ধরা পড়লে এদের মৃতদেহও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর আগাম আশঙ্কায় সুরা পড়ে দোয়া করতে লাগলাম এই দুরন্ত ছেলেদের জন্য। এদের মা-বাবাদের নিশ্চয়ই না জানিয়ে এরা যুদ্ধে এসেছে। এরা মারা গেলে কেউ জানবে এই দুর্বিনীত, বুকভরা সাহসের ছেলেদের কথা? গ্রামের ডান-বাম দিয়ে অর্থাৎ শত্রুর প্রতিরক্ষার দুই পাশ দিয়ে আলাদাভাবে ওরা গ্রামের ভেতর ঢুকে গেল। মেজর খালেদ মোশাররফের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে ছেলেদের তিনি শুধু প্রশিক্ষণই দেননি, কঠোর ও নিপুণ অনুশীলন করিয়েছেন। উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মুহূর্ত। মেজর খালেদ ও আমার কারও মুখেই কোনো কথা নেই।
ঘড়ি পুরস্কারের জন্য নয়, অদম্য সাহস আর কী প্রবল দেশাত্মবোধ ছিল এই কিশোরদের! এ আদেশ শুনে খালেদকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। কিন্তু না, দিনের আলোয় আমাদের সবার সামনে পাকিস্তানি বাংকারগুলো প্রকম্পিত করে ধুলোর আঁধার বানিয়ে ফেলল ওরা। অশ্রুসিক্ত চোখে খালেদ ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। এ যেন এক পিতা সন্তানদের কাঁধে ওজন রেখে হাঁটতে শেখাচ্ছেন।
এর কিছুদিন পর ওয়াই প্লাটুনে আরও কিছু ছেলে যোগ হলো। এদের বয়স আরও কম। এরা ক্লাস ফোর-ফাইভের ছাত্র। দুচোখ ভরা দুষ্টুমি। এদের আবাস ওয়াই প্লাটুনে হলেও লালমাটিয়ার আবদুল আজীজের (বীরপ্রতীক, ১০ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে প্রয়াত) সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ওদের ন্যস্ত করা হয়, ট্রেনিংয়ের দায়িত্বসহ। আবদুল আজীজ এই শিশুদের আপন ভাইয়ের চেয়ে বেশি স্নেহ করতেন। ভারতের এই ক্যাম্পে এই শিশুদের কোনো আপনজন নেই। এরাও ছিল আবদুল আজীজের প্রচণ্ড ভক্ত। দুই পা এক করে স্থির হয়ে দাঁড়ানো ছিল এদের জন্য দুঃসাধ্য। দুটি চোখের মণি, দুটি হাত এবং দুটি পা সব সময়ই নড়ছে। এদের মধ্যে ঢাকার গ্রিন রোডের হাসান, প্রদীপ, শাহজাহান ছিল উল্লেখযোগ্য। ক্যাপ্টেন হায়দার আদর করে এদের নাম দিয়েছিলেন ‘ওয়াকিটকি (সহজে বহনযোগ্য স্বল্পদূরত্বে কথা বলার ছোট একধরনের বেতারযন্ত্র)। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অপারেশনে এদের অবদান কোনো অংশেই সামান্য নয়।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর, মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও লেখক; চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক: সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেল ওয়ার স্টাডিজ

No comments

Powered by Blogger.