সমুদ্র জয় by মোহাম্মদ খুরশেদ আলম

আমাদের সমুদ্রে যে বিপুল সম্ভাবনার কথা বললাম তা এখন কোনোভাবেই আর স্বপ্ন নেই। ২০২১ সালের মধ্যেই এর বেশিরভাগ বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা তিন দিকেই_ মিয়ানমার, ভারত ও মহীসোপানের দিকে চিহ্নিত হয়ে যাবে, এমনটি এখন আর স্বপ্ন বা আশায়

সীমিত নেই। আন্তর্জাতিক আইনেই এ অধিকার আমরা অর্জন করব। এ বিস্তৃত জলরাশিতে এবং তলদেশের নিচে বিপুল সম্পদ রয়েছে_ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এসব কাজে লাগাতে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ_ দক্ষ জনবল এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আমি জেনেছি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সেশন থেকেই ওসেনোগ্রাফি কোর্স চালু হচ্ছে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই জনবল সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়ে যাবে। এক সময় সমুদ্রের পানির নিচে ২ হাজার মিটার পর্যন্ত সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ কাজ চালানো যেত। এখন ৩ হাজার মিটার পর্যন্ত যাওয়া যায়। এ প্রযুক্তিও আমাদের আয়ত্তে এসে যাবে।
এ জনবল ও প্রযুক্তিই আমাদের নতুন পরিকল্পনার ভিত হবে। এটি করতে হবে সরকারকে। প্রথমেই চিহ্নিত করা চাই, সমুদ্রে কী কী সম্পদ রয়েছে। সাধারণভাবে আমরা জানি বঙ্গোপসাগরে তেল, গ্যাস ও মাছ রয়েছে। কিন্তু এখানে কোবালরিচ ক্রাস্ট, পলিমেটালিক সালফাইড, পলিমেটালিক নডিউলস ও গ্যাস হাইড্রেটের মতো মূল্যবান সম্পদও খনিতে নয়, সাগরের তলদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। আমাদের যেটা জানা নেই সেটি হচ্ছে, তা কী পরিমাণে রয়েছে এবং কতটা উত্তোলনযোগ্য। জানা ও অজানা সম্পদ চিহ্নিত করার জন্য আলাদা জরিপ পরিচালনা শুরু করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। গ্যাস হাইড্রেট এক ধরনের বলের মতো। তা থেকে মিলবে গ্যাস। নডিউলস সালফাইড থেকে মিলবে কপার, ম্যাগসেনিয়াম, নিকেল ও কোবাল্টের মতো দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান খনিজ।
আমরা সমুদ্রে মাছের উপস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখি। কিন্তু স্থলভাগে যেখানে ২৭৫ প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী রয়েছে, সেখানে সাগরে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির প্রাণী। এগুলো সম্পর্কে আমরা কমই জানি। এর প্রতিটিই প্রয়োজনীয় এবং অর্থনীতির জন্য উপকারী হতে পারে। আমাদের এটিও জানতে হবে, কোনটির কী পরিমাণ সর্বোচ্চ টেকসই আহরণ সম্ভব। আমাদের উপকূল এলাকা কোনোভাবেই দূষিত হতে দেওয়া যাবে না। সমুদ্রবিজ্ঞান আমাদের শেখায়, চিংড়িসহ অনেক প্রজাতির মাছ আবাসস্থলের পরিবেশ পছন্দ না হলে অন্য এলাকায় চলে যায়। সাধারণত সেগুলো উপকূল এলাকায় কম পানিতে থাকে। তিমি থাকে অনেক গভীর সমুদ্রে। গভীর সমুদ্রের তুলনায় উপকূলে সূর্যের তাপ বেশি এবং এ কারণে খাবার বেশি সৃষ্টি হয়। আমাদের এলাকায় প্রচুর টোনা ফিশ রয়েছে, ইলিশও রয়েছে। এসব মাছ নিয়ে গবেষণা জরুরি হয়ে পড়েছে। উপকূলের পরিবেশ রক্ষা করা না গেলে এখানের অনেক প্রজাতির মৎস্যসম্পদ অন্য এলাকায় মাইগ্রেট করতে থাকবে।
তেল-গ্যাসের বিষয়ে আমার মনে হয়, নতুন ব্লক বরাদ্দ দেওয়ায় তাড়াহুড়োর দরকার নেই। এখন আমাদের সম্পদের ওপর অধিকার স্বীকৃত। এ কাজে দেশি প্রতিষ্ঠান যেমন কাজ করবে তেমনি বিদেশিদেরও যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ তাদের হাতে রয়েছে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ ও প্রযুক্তি। আমরা ভূকম্পন জরিপ চালিয়ে জানতে পারি, কোথায় কী সম্পদ কতটা পরিমাণ রয়েছে। অনুমানের চেয়ে বাস্তবের কাছাকাছি থাকলে ব্লক বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের দরকষাকষি করার ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। আমরা বিভিন্ন কোম্পানিকে বলতে পারব, কোন এলাকায় কতটা সম্ভাবনা।
সুন্দরবন হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এ এলাকা লবণ ছাড়া টিকবে না। এ অঞ্চলে লবণের প্রবাহ কমে যায়_ এমন কিছু করা যাবে না। সেখানের নদ-নদী ও খাল মাছের চমৎকার ব্রিডিং এলাকা। এর ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না।
কক্সবাজার এলাকায় আমরা বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন লবণ পাই সাগরের পানি থেকে। এ পানি ফ্রি। আমরা উন্নত মানের লবণও এ পানি থেকে তৈরি করতে পারি। ফলে এ বাবদ আমদানি ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
কক্সবাজার থেকে ইনানী সৈকত পর্যন্ত রয়েছে ব্ল্যাক ডায়মন্ড নামে পরিচিত জিরকন। সৈকত নষ্ট না করেই এ সম্পদ কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশের সমুদ্রে ৫-৬ মাইল বেগে ঢেউ হয়। এ ধরনের ঢেউ কাজে লাগিয়ে অনেক দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সমুদ্র এলাকার বাতাস কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এসব বিষয় নিয়ে অনেক দেশে গবেষণা হয়েছে এবং বাস্তবে এর প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমাদের কাজ হবে, এ প্রযুক্তি নিয়ে এসে উৎপাদন শুরু করা।
জেলেদের প্রচুর আয় হয় শুঁটকি থেকে। শুঁটকি মাছ থেকেই আমরা পেতে পারি ফিশ অয়েল, ফিশ সস, পাখা ও লেজসহ কয়েক ধরনের সম্পদ।
আমাদের এ সম্পদ রক্ষার জন্য নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। চট্টগ্রাম উপকূল থেকে যতটা এলাকায় ইতিমধ্যেই আমাদের সার্বভৗমত্ব স্বীকৃত হয়েছে সেই নতুন সীমানায় পেঁৗছাতে নৌবাহিনীর একটি জাহাজের সময় লেগেছে ৬২ ঘণ্টা। নতুন সীমানা ধরে পাহারা দেওয়ার কাজ যে কতটা ব্যাপক সে বিষয়ে এ থেকে একটি ধারণা আমরা পেতে পারি।
আমাদের সমুদ্রে যে বিপুল সম্ভাবনার কথা বললাম তা এখন কোনোভাবেই আর স্বপ্ন নেই। ২০২১ সালের মধ্যেই এর বেশিরভাগ বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস।

সরিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ খুরশেদ আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব

No comments

Powered by Blogger.