জাতীয় সংসদ-চরিত্র হননের অসংসদীয় সংস্কৃতি

রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান স্তম্ভের অন্যতম হলো আইনসভা—আমাদের দেশে যাকে বলে জাতীয় সংসদ। গণতান্ত্রিক শাসনের বিকাশে জাতীয় সংসদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু গত চার দশকে আমাদের দেশে একাধিকবার সামরিক শাসন জারি হওয়ায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি।

রাজনীতিতে ‘রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট’ নামের যে শব্দটি চালু আছে, তা এ ধরনের কর্তৃত্বহীন সংসদ থেকে এসেছে। সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতনের পর থেকে ক্ষমতার পরিবর্তনে জনগণের মতামত একমাত্র মাধ্যম হওয়ায় জাতীয় সংসদের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও প্রত্যাশা বেড়েছে। কিন্তু যেসব দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে বা করছে, তারা সে প্রত্যাশা পূরণ করেনি বা করতে চায়নি। এ কারণে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পারেনি। ’৯০ সালের পর থেকে আমরা দেখে আসছি, নির্বাচনে যাঁরা সরকার গঠন করতে পারছেন না, তাঁরাই সংসদ বর্জন করছেন। পরাজিত হলেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। দেখা যাচ্ছে, সংসদে থাকার পরিবেশ নেই—এই অজুহাত তুলে সংসদ বর্জন করলেও প্রতিবারই অনুপস্থিতির ৯০ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই বর্জনকারী দল স্বেচ্ছায় সংসদে ফিরে আসছে। হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে সদস্যপদ রক্ষা করেই আবার সংসদ বর্জনের পথ খুঁজছেন। সংসদে দলগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে কলহ থাকলেও বিভিন্ন সময়ে নিজেদের বেতন-ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি, সরকারি অর্থে বিদেশ সফর, আয়কর না দেওয়া ইত্যাদি প্রশ্নে নাটকীয়ভাবে সবাই মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ। সংসদ বর্জন, সরকারি ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে পরস্পরকে উদ্দেশ করে কটূক্তি, প্রয়াত নেতা-নেত্রীদের নিয়ে অহেতুক ও অনাবশ্যক সমালোচনা, কটূক্তি ইত্যাদি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে।
দীর্ঘ এক বছর পর সংসদের প্রধান বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত হলো। মানুষ ভেবেছিল, তারা সংসদে গিয়ে বর্তমান সরকারের দেশ শাসনের নানা ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনার সুযোগ গ্রহণ করবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা, পুঁজিবাজারে ধস, দুর্নীতি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, উপদেষ্টাদের শাসন ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কথা না বলে বিরোধী দলের কয়েকজন সংরক্ষিত নারী সদস্য সংসদে রুচিহীন, অশা্ললীন ভাষা ব্যবহার করে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন, তা নিন্দনীয়। আমরা এর আগেও সংসদে এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ আলোচনা শুনেছি; দেখেছি, সংসদের স্পিকার অসহায়ের মতো তাঁর কোনো কোনো সদস্যকে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘আমি কিন্তু তোমার পিতার বয়সী।’ এবারও দেখা যাচ্ছে, সেই একই মুখ, যাঁরা সংসদকে জাতির সামনে হেয় করছেন।
এই গালিগালাজের মধ্য দিয়ে বিরোধী দল সংসদে জনগণের অসুবিধা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হাতছাড়া করল। কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা রাড়ছে, জাতীয় ইস্যুতে তারা এক জায়গায় আসতে পারছে না। সংসদের বাইরেও ব্যক্তি আক্রমণ, পরস্পরের চরিত্র হনন ইত্যাদি নিত্যকার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কার জন্ম কোথায়, পূর্বপুরুষের পরিচয়, তাঁদের সমাধী কোথায়—এগুলো জানা জনগণের জন্য নিষ্প্রয়োজন হলেও অকারণে তা সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। মানুষের জীবনের যেসব সমস্যা রয়েছে, তা সমাধান হবে কি না, মানুষ তা-ই জানতে চায়। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান কবে হবে, পদ্মা সেতু আদৌ হবে কি না, ঢাকার যানজট নিরসন কবে হবে—এই বিষয়গুলো রাষ্ট্র বা সরকারের কাছ থেকে মানুষ শুনতে চায়। কিন্তু সংসদের ভেতরে ও বাইরে থেকে অপ্রয়োজনীয় যেসব বিষয়ে বক্তব্য আসছে, তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে এটা মূল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ রাখার কৌশল হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, বিপুলসংখ্যক সদস্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও কখনো কখনো কোরাম সংকটের কারণে সংসদ ঠিক সত বসতে পারছে না। অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য স্পিকার সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিলেও একই ধরনের বক্তব্য কিছু সংসদ সদস্য বারবার দিচ্ছেন। আমরা জানি, দেশের অসংখ্য মানুষ মনোযোগ দিয়ে রেডিও ও টেলিভিশনে সংসদের আলোচনা শোনেন ও দেখে থাকেন। অনেক পরিবারের সদস্যরা অন্য চ্যানেলের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে সংসদের বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা আগ্রহভরে উপভোগ করেন। কিন্তু গত কয়েক দিনে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন ওই সব পরিবার তার সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে সংসদের আলোচনা শুনতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন।
সংসদে সরকারি বা বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখা প্রতিটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলেরই দায়িত্ব। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বিরোধী দলগুলো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে প্রায়ই একটানা সংসদ অধিবেশন বর্জন করে। সংসদীয় রীতিতে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা মনে করি, সরকারের কোনো নীতি বা পদক্ষেপের প্রতিবাদ করার জন্য বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াক আউট করতে পারে, যা সংসদের স্বীকৃত প্রতিবাদের একটি ভাষা। জানা গেছে, এর আগে বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন থেকে ষষ্ঠ অধিবেশন পর্যন্ত ১৬৯টি কার্যদিবসের মধ্যে বিরোধী দল সংসদে ছিল ৪৬টি কার্যদিবস এবং বিরোধী দলের নেত্রী উপস্থিত ছিলেন পাঁচ কার্যদিবস। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখনো একই ঘটনা ঘটেছে।
আমাদের মনে শঙ্কা জাগে। কষ্টার্জিত গণতান্ত্রিক ধারা আবার ব্যাহত না হয়। কেননা এ ধরনের পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম নেয়, আর সেই সুযোগে অন্ধকারের শক্তি উৎসাহিত হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে জনগণের করের টাকায় সংসদ চলে; সংসদে প্রতি মিনিটে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। গরিব দেশের গরিব মানুষের টাকায় সেই মূল্যবান সময়ে মাননীয় (?) সাংসদেরা যে রকম নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় দিচ্ছেন, তা খোদ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকারি ও বিরোধী দল দায়িত্বশীল রাজনীতি করবে, সংসদকে আলোচনার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করবে, নিজস্বার্থে সংসদ সদস্য পদ ব্যবহার করবে না এবং সংসদে অশ্লালীন আলোচনা, রুচিহীন বিতর্ক বন্ধ করবে।
লেখকেরা: মানবাধিকারকর্মী, প্রকৌশলী, আইনজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.