গোটা দেশ একসঙ্গে আলোকিত by এমএ মালেক

এখন বিশ্বের অনেক দেশে শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। প্রতিটি বাড়ি আলোকিত। আমাদের দেশের আয়তন খুব বেশি নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নানা ধরনের প্রযুক্তি এখন বিশ্বে রয়েছে এবং আমরা চেষ্টা করলেই তার সুফল হাতের নাগালে নিয়ে আসতে পারি

২০২১ সালে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ২০ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে যেসব ছোট ও বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু রয়েছে সেগুলো একসঙ্গে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় উৎপাদন করলেও আমরা বড়জোর ৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত যেতে পারব। আগামী ৯ বছরে কি বাংলাদেশে আরও ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অসংখ্য কেন্দ্র স্থাপন এবং সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বণ্টন করার ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব?
এটা করার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে, একটি কার্যকর রূপরেখা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে অর্থের জোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য আয়োজন।
গত তিন বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বেড়েছে, এমনটিই দাবি করা হয় এবং তাতে যথার্থতা রয়েছে। তবে এ অর্জন এসেছে ছোট ছোট বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে এবং এগুলো খুবই ব্যয়বহুল। প্রাকৃতিক গ্যাসের জোগান পর্যাপ্ত না হওয়ায় নতুন প্লান্টগুলোতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল। কিন্তু বিশ্ববাজারের কারণেই দেশের বাজারে এ জ্বালানির দাম চড়া এবং আগামীতে কমবে, এমন সম্ভাবনা নেই। ডিজেল ব্যবহার করা বিদ্যুৎ প্রকল্পে এক কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ে ১৬ টাকার কাছাকাছি। ফার্নেস অয়েলে পড়ে ১১-১২ টাকা। কেন্দ্রগুলো যারা স্থাপন করেছেন, তাদের সরকারের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে স্বল্প সময়ের জন্য। এ সময়ের মধ্যেই তারা ব্যয় ও লাভ তুলে নিতে চায়। তাদের আরও ভয়, পরে যদি চুক্তি নবায়ন না হয়?
এর পাশাপাশি আরেকটি তথ্য আমাদের জানা_ বাণিজ্যিক, শিল্প ও গৃহস্থালি প্রয়োজনে ব্যবহার করা বিদ্যুৎ থেকে প্রতি ইউনিটে গড়ে আয় হয় ৪ টাকার মতো। এই যে আয়-ব্যয়ে ব্যবধান সেটা জোগান দেওয়া হয় সরকারি তহবিল থেকে। সম্ভবত সরকার পূর্বাপর না ভেবেই এ পথে চলেছে। আর এর প্রেক্ষাপটও ছিল ব্যাপক হারে লোডশেডিং। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি সমাধান যে এত বড় বোঝা নিয়ে আসবে, সেটা ভাবা হয়নি।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়েছে, এমন দাবি কেউ করবে না। এমনও অভিযোগ রয়েছে, ছোট ছোট প্লান্টের উদ্যোক্তারা নিম্নমানের মেশিন এনেছেন এবং এগুলোতে ভর্তুকি মূল্যে ডিজেল-ফার্নেস অয়েল জোগান দিতে গিয়ে সরকার ফতুর হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা থেকে রেহাই মেলেনি। গরম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার সিএনজি গ্যাস স্টেশন আরও দুই ঘণ্টা বেশি বন্ধ রাখছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ কার্যত দেওয়া হচ্ছে না। অনেক ফ্ল্যাট বাড়ি গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ পাচ্ছে না। এতে প্রচুর বিনিয়োগ থেকে কাঙ্ক্ষিত লাভ মিলছে না।
অনেকেরই মত, তিন বছর আগে সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই উচিত ছিল কম্বাইন্ড সাইকেলের বড় বড় প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া। এজন্য জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার বেশি হলে সেটাই হতো সর্বোত্তম। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন এবং ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। এখন যে প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে তাতে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের কারণে আশপাশের পরিবেশ দূষিত হওয়ার শঙ্কা একেবারেই সীমিত। এটাও মনে রাখতে হবে, উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা রয়েছে।
কয়লা সম্পদে বাংলাদেশ মোটামুটি সমৃদ্ধ। বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে সীমিত পরিমাণে। ফুলবাড়ী থেকে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে কোন পদ্ধতিতে তোলা হবে, সেটা নিয়ে সমস্যা প্রকট।
২০২১ সালে আমরা কোথায় যেতে চাই, সেটা এখন কেবল চূড়ান্ত করা নয়, বাস্তবায়নেরও কাজ শুরু করতে হবে। এক একটা বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ সম্পন্ন হতে তিন-চার বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের ওপরে যেহেতু জোর দিতে হবে, সে কারণে কয়লা নীতি চূড়ান্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কয়লা তোলা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর পরিবহনও মোটেই সহজ নয়। এ জন্য রেলপথ হচ্ছে সবচেয়ে উপযোগী। যেখানে খনি রয়েছে, ওপেন পিট পদ্ধতিতে তোলা হলে তার আশপাশের অনেক লোককে সরিয়ে নিতে হবে। আমরা যমুনা ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে এ ধরনের পুনর্বাসনের কাজ করেছি। এতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের যদি আগের চেয়ে উন্নত জীবন ও বসবাসের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এতে সরকারের প্রচুর ব্যয় পড়বে। কিন্তু হিসাবটা যদি এভাবে করি_ এ ব্যয় বেশি, নাকি ডিজেল-ফার্নেল অয়েল ব্যবহার করলে বছরের পর বছর জ্বালানি বাবদ যে ভর্তুকি দিতে হয়, সেটা বেশি, তাহলে সিদ্ধান্তে পেঁৗছানো সহজ হবে।
গত চার-পাঁচ বছরে কয়লা তোলার বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ওপেন পিট পদ্ধতিতে খনি থেকে মোট কয়লার শতকরা ৯০ ভাগ তুলে আনা যায়। কিন্তু এর বিপরীতে খনির ভেতর বিশেষ ব্যবস্থা করে কয়লা তুলে আনতে হলে ৩০ শতাংশের বেশি উত্তোলন করা যাবে না। পেট্রোবাংলাকে যখন বড়পুকুরিয়া খনি দেওয়া হয় তখন তাদের সঙ্গে ২০ শতাংশ রয়্যালটি প্রদানের চুক্তি হয়েছিল। এ খনি থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কয়লা তোলা যাবে। কিন্তু ফুলবাড়ী থেকে তোলা যাবে ওপেন পিট পদ্ধতিতে। এখানে রয়্যালটি হওয়া উচিত আনুপাতিক হারে আরও বেশি। কিন্তু এশিয়া এনার্জির সঙ্গে কেন ৬ শতাংশ রয়্যালটিতে চুক্তি হয়েছিল, সেটা বোধগম্য নয়। অফসোরে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের বিষয়েও যেসব চুক্তি অতীতে হয়েছে তাতেও জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করা হয়নি।
২০২১ সালে দেশের সব গ্রামে বিদ্যুৎ পেঁৗছে যাবে, এমন প্রত্যাশা করাই যায়। রাজধানী ঢাকা এবং বড় বড় শহরে যেসব বস্তি রয়েছে সেগুলোতে বসবাসের পরিবেশের পাশাপাশি বিদ্যুতের আলো পেঁৗছবে, এমন প্রত্যাশাও থাকবে। এজন্য মোটামুটি ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাই। এখন থেকে অনেক দেশি-বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হলে এ লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়। কিন্তু আবারও বলছি, কয়লা থেকেই বেশিরভাগ বিদ্যুৎ পেতে হবে। আর প্রকল্পগুলো হতে হবে বড় আকারের। ইতিমধ্যে দুটি কয়লাভিত্তিক প্রকল্প নিয়ে অগ্রগতি হয়েছে যেখানে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ ধরনের প্রকল্পই আমাদের জন্য লাভজনক।
সমুদ্রে বাংলাদেশের দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে, এখন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের কাজ সহজ হবে। কিন্তু চুক্তি করার সময় জাতীয় স্বার্থ কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন হতে দেওয়া যাবে না। এ সম্পদ আমাদের। যাদের হাতে তা তুলে দেওয়া হবে তারা ভিক্ষার মতো কিছু অর্থ আমাদের হাতে তুলে দেবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। বেশিরভাগ লাভ আমাদেরই থাকতে হবে। সমুদ্র থেকে গ্যাস মূল ভূখণ্ডে নিয়ে এলে জ্বালানি সমস্যার বহুলাংশে সুরাহা হবে।
কয়েক বছর আগে আমি পশ্চিমবঙ্গের ডায়মন্ড হারবারের কাছে একটি দ্বীপে গিয়েছিলাম। সেখানে সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তাতে ৪-৫ বর্গকিলোমিটার আলোকিত হয়। অন্যান্য কাজও ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়। ব্যাঙ্গালোর শহরের সব ট্রাফিক বাতি জ্বলে সৌরবিদ্যুতে। ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সৌর প্যানেলের জন্য ৭৫ শতাংশ ভর্তুকি দেয়। তারা হিসাব করে চূড়ান্ত লাভ নিয়ে। জ্বালানি খাতে ভর্তুকির তুলনায় এ ভর্তুকি কম বলেই তারা মনে করছে। আমাদের সৌরবিদ্যুৎ কাজে লাগানোর জন্য কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ খাতে ক্রমে বরাদ্দ বাড়িয়ে যেতে হবে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিতে হবে।
বায়োগ্যাস প্রকল্পও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ছোট ছোট বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে। একবার ভাবুন তো, এ থেকে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা গ্রামের কৃষকদের গরু কেনার জন্য ভর্তুকি হিসেবে দিলে তাতে কত ধরনের লাভ হতো? ব্যাংকগুলো স্বল্প সুদে তাদের ঋণ জোগাতে পারে। এভাবে আমরা রান্নার বায়োগ্যাস পেতে পারি, যা আবার বিদ্যুতেরও উৎস। একই সঙ্গে গরু থেকে মিলত দুধ, মাংস ও জৈব সার এবং আরও কত কী। কেন আমরা এভাবে চিন্তা করতে পারি না?
আমাদের উইন্ড এনার্জির পথেও চলতে হবে। একই সঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি। জাপানের ফুকুশিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভূমিকম্প ও সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ বিষয়ে ভীতি বেড়েছে। কিন্তু অনেক দেশেই পরমাণু শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ইস্যুটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। মনে রাখা চাই, আমাদের আগামী ৯ বছরে আরও ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। এজন্য সম্ভাব্য সব উপায় কাজে লাগাতে হবে।
এখন বিশ্বের অনেক দেশে শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। প্রতিটি বাড়ি আলোকিত। আমাদের দেশের আয়তন খুব বেশি নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নানা ধরনের প্রযুক্তি এখন বিশ্বে রয়েছে এবং আমরা চেষ্টা করলেই তার সুফল হাতের নাগালে নিয়ে আসতে পারি। এজন্য অর্থের জোগান অবশ্যই বড় সমস্যা। কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই দেশের গোটা অংশ একসঙ্গে আলোকিত করতে চাইব।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এমএ মালেক : বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের
সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.