এই দিনে-আজ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস by গাজীউল হক

চারদিকে সবুজের সমারোহ। দৃষ্টিনন্দন লালমাটির পাহাড়। সুউচ্চ টিলা। প্রাচীন সভ্যতার নির্দশন। শালবনে ঘেরা প্রকৃতির অদ্ভুত ভালোলাগা আর শান্ত-সরল মানুষের যাপিত জীবন। নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির। লালমাই পাহাড়ের বুকে এখন ধবধবে সাদা রঙের সুউচ্চ দালান। প্রকৃতির এমন মনোলোভা লালমাই পাহাড়েই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

আজ শনিবার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এই দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা সাজানো হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এককাট্টা হয়ে আনন্দ-উৎসবে মুখর করে তুলবেন সমতট অঞ্চলের পাদপীঠকে।
দিনটি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠান ও প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘শিরোনামহীন’ ব্যান্ডের কনসার্টের আয়োজন করেছে। ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা মো. মুহসীন উদ্দীনকে আহ্বায়ক এবং রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ কে এম রায়হান উদ্দিনকে সদস্য-সচিব করে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদ্যাপন কমিটি গঠন করা হয়। সঙ্গে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথম ঘটা করে এমন আয়োজন। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের প্রত্যয়’।
কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এর অবস্থান। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজার ১৪৬ জন শিক্ষার্থী, ৮৫ জন শিক্ষক এবং শতাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী দিয়ে ১৪টি বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রমসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, লোকপ্রশাসন, নৃবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা শিক্ষা, হিসাববিজ্ঞান, মার্কেটিং, পরিসংখ্যান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) বিষয়ে স্নাতক কোর্স রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এর আয়তন, বিভাগ ও লোকবল বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নানাভাবে ঐতিহ্য বহন করছে। প্রাচীনকালে প্রাচীন বাংলার ‘সমতট’ রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল ‘লালমাই-ময়নামতী’। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে (কারও কারও মতে সপ্তম শতাব্দী) দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ওই রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৫০০ মাইল। সপ্তম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশীয় রাজা ভবদেব এখানে আনন্দ বিহার বা শালবন বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। ওই বিহার এশিয়ার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিগণিত হয়। সে সময় একে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং আনন্দ বিহারে আসেন। তখন বিহারে চার হাজার ভিক্ষু (ছাত্র) ছিল। হিউয়েন সাং ময়নামতী অঞ্চলে ৩৫টি শিক্ষাকেন্দ্র (বিহার) দেখতে পান। তখন তিনি সমতট তথা কুমিল্লাবাসীকে প্রবল শিক্ষানুরাগী বলে আখ্যায়িত করেন। সেই আনন্দ বিহার এলাকা ঘেঁষেই ময়নামতী-লালমাই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য গোলাম মাওলার ভাষ্যমতে, ষাটের দশক থেকে কুমিল্লাবাসী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জানিয়ে আসছিল। কুমিল্লাবাসীর দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন সরকার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রামে। এর পর থেকেই কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন বেগবান হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) কুমিল্লায় একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু পরে তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০০৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কুমিল্লার জনসভায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেন। এরপর ২০০৪ সালের ১ জুলাই প্রকল্প তৈরি করা হয়। ওই বছরের ৯ অক্টোবর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে কুমিল্লায় একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ২০০৪ সালের ৬ নভেম্বর একনেকের বৈঠকে তা অনুমোদিত হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে গৃহীত হয়। একই সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা শুরু হয়। প্রায় ছয় কোটি তিন লাখ ৬০ হাজার ৩৬৫ টাকা এই খাতে ব্যয় হয়। ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে ২০০৬ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে পাস হয়। ওই বছরের ৮ মে বাংলাদেশ গেজেটে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে সাতটি বিভাগে ৩০০ শিক্ষার্থী, ১৫ জন শিক্ষক ও ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমির হোসেন খান বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। একে আমরা ঢেলে সাজাতে চাই। সবার সহযোগিতায় এর পরিবেশ সুন্দর রাখতে চাই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরীর মতে, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় মানে কুমিল্লার মানুষের প্রাণের আকুতি, একসময়ের ধ্যানের ছবি, আরাধ্য বিষয়, হাতের মুঠোয় এক ফালি চাঁদ। আমরা সেই চাঁদের আলোয় আলোকিত হতে চাই।’
গাজীউল হক

No comments

Powered by Blogger.