শিশু গৃহকর্মীদের ৯৫ শতাংশই নির্যাতনের শিকার হয় by রাব্বী রহমান

০ বছরের রোমেলা খাতুন নির্যাতনের শিকার হয় সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহেদ আলীর বাসায়। লাগাতার মারধরে মেয়েটি ক্ষতবিক্ষত হয়, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পাবনার এই মেয়েটি কয়েকবার আত্মহত্যারও ব্যর্থ চেষ্টা করে। রোমেলা এখনো পাবনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সর্বশেষ মারধরের ঘটনার পর রোমেলা সাংবাদিকদের বলেছিল, ছোটখাটো অজুহাতে তাকে প্রায়ই মারধর করা হতো। একবার বেধড়ক পিটুনিতে তার মুখ কেটে গেলে শাহেদ আলীর স্ত্রী সুইটি বেগম নিজেই কাপড় সেলাইয়ের সুঁই-সুতা দিয়ে কাটা সেলাই করে দেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) কয়েকজন কর্মকর্তা বাসার কাজের মেয়েদের ওপর নির্যাতন এবং আত্মহত্যার কারণ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এ কথা বলেন।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, হাজার হাজার রোমেলা প্রতিদিনই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এদের অনেকে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের মতো পথ বেছে নিচ্ছে। গৃহশ্রমিক নির্যাতন বা হত্যা বা আত্মহত্যার সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক গৃহশ্রমিকের হত্যার পর গৃহকর্তা বা কর্ত্রীকে বাঁচাতে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিচ্ছে পুলিশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী গৃহশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৩১ হাজার। বর্তমানে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। অথচ এই বৃহৎ শ্রমের শ্রমিকদের পরিচালনা বা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো নীতিমালা। খসড়ায় যে একটা নীতিমালা রয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি ও এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী ও শিশুশ্রমিক। এই নারী ও শিশুরাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বেশি।
গত ১১ অক্টোবর সকালে রাজধানীর জাপান গার্ডেন সিটির ১১ নম্বর ভবনের ১৪ তলা থেকে পড়ে মারা যায় ১২ বছরের শিশু গৃহকর্মী মনি। ঘটনার পরই পুলিশ গৃহকর্ত্রী মাহে জিনাত টিসা ও তার ভাই রোহিতকে আটক করে। এ ব্যাপারে মনির এক ফুফু বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। অভিযোগ করা হয়, নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতেই ১৪ তলার গ্রিল বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করছিল মনি। সেখান থেকেই সে নিচে পড়ে মারা যায়। পুলিশ তদন্তে নিশ্চিত, মনিকে প্রায় প্রতিদিনই অমানুষিক নির্যাতন করতেন বাড়ির গৃহকর্ত্রী টিসা। মামলাটির এখনো তদন্ত চলছে।
৩২টি বেসরকারি সংস্থা ও ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সংগঠন গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ১০ বছরে গৃহশ্রমিকদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৭৯৮টি। এর মধ্যে নির্যাতনে নিহত হয়েছে ৩৯৮ জন, আহত হয়েছেন ২৯৯ এবং অন্যান্য নির্যাতনে শিকার প্রায় ১০০ জন। এরমধ্যে গত ২০১০ সালে ৫৬ জন গৃহশ্রমিকের মৃত্যু হয়। আর এ বছর অক্টোবর পর্যন্ত ৩৩ জন মেয়ে গৃহকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় বলে জানায় গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক। গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক ২ নভেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। সেখানে তারা বলেন, গৃহকর্মীরা মারা যাওয়ার পর গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর কাছ থেকে পুলিশ টাকার বিনিময়ে তা অপমৃত্যু ও আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহশ্রমিকদের কারোরি নিয়োগ চুক্তি নেই। তাদের গড় মজুরি ৫০৯ দশমিক ৬ টাকা। এরমধ্যে নিয়মিত মজুরি পায় ৬০ শতাংশ এবং অনিয়মিত মজুরি পায় ৪০ শতাংশ। এত অল্প মজুরিতেও নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তারা। এরমধ্যে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ শিক্ষার সুযোগ এবং ৫৩ দশমিক ৩৩ চিত্তবিনোদনের সুযোগ পায় না। বকাঝকার শিকার হয় ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ করে ৬৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যৌননিপীড়ন সহ্য করে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, মানসিক হতাশায় ভোগে ৬৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ গৃহশ্রমিক।
গৃহশ্রমিকের ঘুমানোর জন্য যথার্থ স্থানও দেওয়া হয় না। ড্রইং রুমে ২০ শতাংশ, রান্নাঘরে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, বারান্দায় ১৬ দশমিক ৬৭, স্টোর রুমে ৩ দশমিক ৩৩, বেড রুমের মেঝেতে ২০ দশমিক ৬৭ এবং আলাদা রুমে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ গৃহকর্মী ঘুমায়।
গত ২০ ডিসেম্বর সিরডাপ মিলনায়তনে বেসরকারি সংস্থা নারী মৈত্রী গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা ২০১০-এর খসড়া নীতিমালাটি জাতীয় শিশু নীতিমালায় সম্পৃক্তকরণ নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করে। এতে গৃহশ্রমিকদের নিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে জানানো হয়, বাসা-বাড়ির কাজে নিযুক্ত ৯৫ শতাংশ শিশু গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এক পরিবারের প্রধান কর্তা ছাড়া নির্যাতনকারীদের ৩০ শতাংশ পরিবারের অন্যান্য সদস্য। এসব শিশুর মধ্যে ৫২ শতাংশ নিয়মিত নির্যাতিত হয়। মৌখিক (গালি) নির্যাতনের শিকার হয় ৯৫ শতাংশ। আর ৮৬ শতাংশ শিশু শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়। ৯৩ শতাংশ নিয়মিত খাবার পায়, আর ৮২ শতাংশ পরিবার সময়মতো খাবার দেয়। রাজধানীর ধানমণ্ডি, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের তিনটি ওয়ার্ডের ৮৪৯টি বাড়িতে পরিচালিত এ জরিপে আরো বলা হয়েছে, ৫০ শতাংশ শিশু সময়মতো জামা-কাপড় পায়।
গৃহশ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়ে অপমৃত্যু মামলাই বেশি করা হয় এবং পরে এ ঘটনাগুলো আর তদন্ত করে দেখাতে অনীহা করে পুলিশ। এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এর কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি মামলার তদন্ত হয়। তদন্তে যদি হত্যা প্রমাণিত হয় তবে তা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। তিনি আরো বলেন, থানায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তে অনীহা প্রকাশ করলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর এ বিষয়ে যদি কর্তব্যে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সচিবালয় হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। এর আইনজীবী নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, গৃহকর্তা বা কর্ত্রীকে বাঁচাতে অনেক গৃহশ্রমিকের হত্যার পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং তদন্তে পারিপার্শ্বিক স্বাক্ষরের ওপর গুরুত্ব ঠিকমতো দিচ্ছে না। আর গৃহশ্রমিকদের বিষয়ে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বগুড়ার টেংরার মেয়ে ধলি বেগম (৫০) ঢাকার একজন গৃহকর্মী। তিনি সর্বশেষ কাজ করেন ঢাকার তেজগাঁও ২২/এ, মণিপুরীপাড়ার মনসুর আলমের বাসায়। পরে ওই বাসায় স্বর্ণের একটি চেইন হারানোর পর চুরির অভিযোগে গত বছর ২৪ ডিসেম্বর শুক্রবার ধলিকে আটক করা হয়। পরে ২৬ ডিসেম্বর ওই বাসার রান্নাঘর থেকে ধলি বেগমের লাশ উদ্ধার করা হয়। ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে দাবি করে অপমৃত্যুর মামলা হয় তেজগাঁও থানায়। ধলি বেগমের মেয়ে লতা বেগমের ভাষ্যমতে, বাড়িওয়ালা মনসুর ও তার স্ত্রী ফারজানা নির্যাতন করে তার মাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রেখেছে। তার মা আত্মহত্যা করতে পারে না। থানায় একটি ডিজিও করেন লতা। আটক করা হয় ওই বাড়ির দুজনকে। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফরমান লতাকে ডেকে মীমাংসার প্রস্তাব দেয়। লতা প্রথমে রাজি না হলেও গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় এসে বিচার চাইলে তাঁর স্বামী তাকে তালাক দেবে এবং কোলের ছেলেকে কেড়ে নেবে ভয়ে তিনি আর এগোননি। পরে ৬০ হাজার টাকায় বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়।
বিলসের সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষায় ও কল্যাণে কোনো নীতিমালা নেই। 'গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা'-এর খসড়া ২০০৯ সাল থেকেই মন্ত্রণালয়ে ঘষামাজা চলছে। তিনি বলেন, ফৌজদারি আইনের আওতায় নির্যাতনের শিকার গৃহশ্রমিক ও তাদের অভিভাবকরা সুরক্ষা পাচ্ছেন না। কেননা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী থাকে সমাজের প্রভাবশালী মহলের কেউ।
গত ২৬ নভেম্বর রাজধানীর মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে মতিঝিল থানা নারী কমিউনিটি পুলিশের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে নতুন আইন তৈরির জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেন। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আইনে উল্লেখ থাকবে গৃহকর্মীরা কত ঘণ্টা কাজ করবে, তাদের বয়স কত হবে, বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা, ছুটি কী হবে।

No comments

Powered by Blogger.