তদন্ত কমিটির সুপারিশ-নিজ শিক্ষার্থীকে কোচিং করানো যাবে না by মোশতাক আহমেদ

কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় বা অন্য কোথাও কোচিং করাতে পারবেন না। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। কোচিং বন্ধে করণীয় ঠিক করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা কমিটি এই সুপারিশ করেছে।


এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি তদন্ত কমিটি ভর্তির জন্য নেওয়া বাড়তি টাকা ফেরত অথবা শিক্ষার্থীদের পরবর্তী মাসিক বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করার সুপারিশ করেছে।
দুটি কমিটিই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কোচিং-সংক্রান্ত কমিটি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে এবং ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়া-সংক্রান্ত কমিটি শিক্ষাসচিব বরাবর প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবক ঐক্য ফোরাম নামের একটি সংগঠনের পক্ষে আদালতে রিট করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত কোচিং বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বা কেন কোচিং বন্ধে পরিপত্র জারি করা হবে না, তা জানতে রুল জারি করেন। এরপর শিক্ষামন্ত্রী ৪ জানুয়ারি রিটের বিবাদীপক্ষ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে জরুরি সভা করেন।
ওই সভায় কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে করণীয় ঠিক করে সুপারিশ দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক) এ এস মাহমুদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটি গত বৃহস্পতিবার শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও চাই কোচিং বন্ধ করে দিতে। তবে হঠাৎ করে বন্ধ করা যাবে না। আমাদের বাস্তবতার নিরিখেই এগোতে হবে। প্রতিবেদন পেয়েছি, এখনো দেখিনি। দেখার পর করণীয় ঠিক করা হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেদনের আলোকে আদালতের রুলের জবাব দেওয়া হবে। একই সঙ্গে কোচিং সীমিত রাখার বিষয়ে মন্ত্রণালয় সভা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
কোচিং বিষয়ে সুপারিশ: প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিছিয়ে পড়া বা দুর্বল শিক্ষার্থী বাছাই করে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে এক ঘণ্টার ক্লাসের জন্য ১৭৫ টাকার সম্মানীর বিষয়টি পুনর্নির্ধারণ করা যেতে পারে।
এর আগে ২০১০ সালের আগস্টে মন্ত্রণালয় এক ঘণ্টার একটি অতিরিক্ত ক্লাসের জন্য ১৭৫ টাকা হারে সম্মানী ঠিক করে দেয়।
কোচিংয়ের বিষয়ে কমিটি বলেছে, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় বা অন্য কোথাও পড়াতে পারবেন না। তবে এক ব্যাচে সীমিত আকারে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। কোচিং-সংক্রান্ত এই নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা জানিয়ে কমিটির প্রধান এ এস মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোচিং রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না। হঠাৎ করে করলে সেটা বাস্তবায়নও করা যাবে না। এ জন্য আমরা সীমিতভাবে করার কথা বলছি।’
পর্যালোচনা ও সার্বিক মন্তব্য: কমিটি পাঁচ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে কোচিং-বাণিজ্য গড়ে ওঠার কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি, প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি পর্যালোচনা করেছে। এতে বলা হয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সুশীল সমাজের অনেকেই কোচিংয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের উৎকর্ষ সাধনের জন্য নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত পাঠদান সময়ের পর কোচিংয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা ওই মানের (দুর্বল) শিক্ষার্থীদের বাছাই করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারেন। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক—সব পক্ষই উপকৃত হবে। কারও কারও মত, হঠাৎ কোচিং বন্ধ করা হলে পরীক্ষায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কমিটি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূনসহ কয়েকটি স্কুল পরিদর্শন ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেছে কমিটি। বর্তমান বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য দুর্বল ও মেধাবী উভয় ধরনের শিক্ষার্থীদের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা নেওয়া সমীচীন হবে বলে মনে করেন তাঁরা। তবে কোনো শিক্ষক তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না বলে মত দেন তাঁরা।
জানতে চাইলে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে তাঁদের কাছে পড়তে বাধ্য করেন, না হলে পরীক্ষার ফল খারাপ করে দেওয়া হয়। আবার কোনো কোনো শিক্ষক আছেন, যাঁদের কাছে পড়লে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেন। পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দেন। শিক্ষকদের এই লুণ্ঠন শিক্ষার্থীদের শুধু ক্ষতিই করে না, তাদের ভবিষ্যৎকেও নষ্ট করে দেয়। এ জন্য আমি বলেছি, নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো উচিত নয়। তবে শিক্ষকদের বিষয়টিও দেখতে হবে। এ জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারবেন এবং নিজ প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলেছি।’
ভর্তির বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়ার সুপারিশ: বেসরকারি স্কুলগুলোয় ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়ার বিষয়টি তদন্তে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নোমান উর রশীদকে প্রধান করে কমিটি করে মন্ত্রণালয়। গতকাল সোমবার এই কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। শিক্ষাসচিবের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন কমিটির সদস্য ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুস সামাদ।
জানতে চাইলে সচিবের চলতি দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত শিক্ষাসচিব এস এম ফারুক জানান, শিক্ষাসচিব দেশের বাইরে আছেন। আজ দেশে ফেরার পর প্রতিবেদনটি খোলা হবে।
কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, প্রায় ৩৫টি স্কুলে খোঁজখবর নিয়ে তাঁরা দেখেছেন, ১৫টির মতো প্রতিষ্ঠান ভর্তিতে সরকার-নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি টাকা নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন, মতিঝিল আইডিয়াল, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ নামীদামি স্কুল রয়েছে। আরেকজন সদস্য বলেন, কোন স্কুল কত টাকা নিয়েছে, তার একটি তালিকাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, ঢাকার বেসরকারি স্কুলগুলোয় ভর্তিতে পাঁচ হাজার টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। কিন্তু এবার রাজধানীর বেশির ভাগ স্কুল এই নিয়ম মানেনি।

No comments

Powered by Blogger.