স্টিফেনের তত্ত্বে ব্ল্যাকবার্ন! by শেরিফ আল সায়ার

ন্ম সার্থক হয়। এটা শুনেছি। এ সার্থকতা কীভাবে আসবে? কিন্তু স্টিফেন হকিংয়ের দিকে তাকালে মনে হয় জন্মের সার্থকতা এটাই। মাত্র ২১ বছরে যে মানুষটি মটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়েছেন। মস্তিস্ক এবং দু চোয়াল ছাড়া তাঁর শরীরের বাকি সব সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। এমন মানুষ এখনও হার মানান বিশ্বের সব সুস্থ সবল মানুষকে। এখনও গবেষণা করে চলেন।

এখনও আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে নিরলস কাজ করছেন স্টিফেন। এবারে স্টিফেন হকিং পা রাখলেন সত্তরে। হকিংয়ের ৭০তম জন্মদিনে লন্ডনের কিংস কলেজের মটর নিউরনের পরিচালক আম্মার আল চালাবি বলেন, এমন আরেকজন মানুষ আমি দেখিনি যিনি এ রোগের পরও এতদিন বেঁচে আছেন। সাধারণত এমন রোগের পর খুব বেশিদিন কেউ বেঁচে থাকে না। কিন্তু অদম্য স্টিফেন পার করেছেন ৭০ বছর। এখনও হুইল চেয়ারে বসে বিশ্বজয়ে মাতোয়ারা হকিং।

স্টিফেন বাকশক্তি হারান ১৯৮৬ সালে। এরপর ১৯৮৮ সালে তার ‘এ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বে নড়েচড়ে বসেন এ বই পড়ে। পৃথিবীর গঠন, উৎপত্তি তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয় যুগান্তকারী এ বইয়ে। পৃথিবী গঠনের আগে সময় ছিল কিনা? এমন প্রশ্নের নানাবিধ ব্যাখ্যা দেন এ বইয়ে। এ বইয়ের ‘বিক ব্যাং থিউরি’ সবচে বেশি আলোচিত হয়। এ বইটির ১ কোটি কপি বিক্রি হয়।

বাক শক্তি হারিয়েও স্টিফেন অন্যের সঙ্গে অবিচল যোগাযোগ করেন। এ মুহূর্তে স্টিফেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘থিওরেটিক্যাল কসমোলজি সেন্টার’ গবেষণা দলের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু তার আগে তিনি ক্যামব্রিজে অধ্যাপনা করতেন।

শুধু হকিংয়ের জন্যই তৈরি হয় বিশেষ প্রযুক্তি। ১৯৮৫ সাল থেকে ডান গালে নাড়িয়ে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হকিং। এর জন্য প্রয়োজন হয় ঘড়ি, কম্পিউটার এবং ভয়েস সিনথেসাইজার। খুদে ইনফ্রারেড সেন্সর তার চশমার ওপর বসানো হয়। বিশেষ এ সেন্সরের দুটি সংযোগের মধ্যে একটি থাকে তার কম্পিউটারের সঙ্গে। অন্যটি তার ডান গালে। সেন্সরটি শুরুতে হকিংয়ের গালের পালস সনাক্ত করে। তার সে শব্দ তৈরি করে কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখানো হয়। এ শব্দগুলো কম্পিউটারে প্রদর্শিত হয়, সেগুলোই ভয়েস সিনথেসাইজারের মাধ্যমে শব্দের আকারে বের হয়। এ পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সময় নেয় ১০ মিনিট।

১৯৮৫ সাল থেকেই এভাবেই চলেছে। কিন্তু বিপত্তি হয় ২০০৬ সালে। হঠাৎ করেই এ সিস্টেমটি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হকিং ভক্তদের মনে নেমে আসে অন্ধকার। গবেষণার ঘোরে বিভোর হকিংয়ের চোখেও হতাশার ছাপ। ঠিক এ মুহূর্তে তার সহযোগী অধ্যাপক স্যাম ব্ল্যাকবার্ন এগিয়ে আসেন। হকিংয়ের ভাষাকে আবারও ফিরিয়ে দিতে তিনি কাজ শুরু করেন।
এ প্রসঙ্গে ব্ল্যাকবার্ন বলেন, একদিন হঠাৎ শুনতে পাই স্টিফেন কথা বলতে পারছেন না। তখন আমরা কী করতে পারি? এ নিয়ে ভাবতে থাকি। তখন এ সিস্টেমকে আধুনিক করে তুলতে কাজ শুরু করি। প্রথমেই সেন্সরটিকে আপডেট করা হয়। ইনফ্রারেড সেন্সরকে স্টিফেনের চোয়ালের সঙ্গে লাগানো হয়।

এ আধুনিকায়ন স্টিফেনের জন্য কোনো ব্যপার নয়। আমাদের মনে রাখতে হয়েছিল আগের প্রক্রিয়াটি রেখেই সিস্টেমটি আপডেট করা। কারণ নতুন প্রক্রিয়ায় সে যদি কমিউনিকেট করতে না পারে, তবে এ সাহায্যের জন্যও আমাদের বলতে পারবেনা।

নতুন সিস্টেম তৈরিতে ব্ল্যাকবার্ন বিপাকে পড়েন। ১৯৮৫ সাল থেকে স্টিফেনের সব ধরনের ভয়েস রেকর্ডের প্রয়োজন দেখা দেয়। কারণ একটি প্রসেসর পুরোনো সিস্টেমে যুক্ত ছিল। যা টেক্সটকে ভয়েসে রূপান্তরিত করে।

এবং এ ভয়েসটি পুরোপুরি স্টিফেনের। ভয়েস রেকর্ড সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্ল্যাকবার্ন মাত্র দুটি কার্ড পায়। কিন্তু পুরোটা না পেলে সিস্টেমটি আপডেট করা অসম্ভব। তাই তিনি স্টিফেনের ভয়েসের মতো করেই আউটপুট নিয়ে আসার আশাবাদ দেন।
তবে ব্ল্যাকবার্ন আগের ভয়েস সিনথিসাইজারটাই রেখে দেন। যদিও ভয়েস একটি স্টিফেনের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এবারের সিস্টেমটিতে আর তার ভয়েস দেওয়া না গেলেও আগের চেয়ে তা অনেক স্পষ্ট হয়ে গেছে। এবং একই সঙ্গে আগে রোবোটিক ভয়েস আউটপুটটিও এখন আর নেই।

ব্ল্যাকবার্ন এ সিস্টেম প্রসঙ্গে বলেন, আগে স্টিফেন তার হাত নাড়াতে পারতেন। তাই তখন সেন্সরটি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বাটন ছিল। যা তিনি প্রেস করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। কিন্তু পরে হাত নাড়ানোর শক্তি হারিয়ে যাওয়ার পর তার চোয়ালকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ গবেষণা সম্পর্কে সম্প্রতি ব্ল্যাকবার্ন বলেন, আসলে এখন আমাদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে হবে। সামনে হয়ত স্টিফেন চোয়াল নড়াচড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলবেন। তখন আমাদের ব্রেইন স্ক্যানিং নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা এ নিয়ে কাজও শুরু করে দেব। তার আগে আই স্ক্যানিং নিয়ে কাজ করছি।

স্টিফেন ভক্তরা ব্ল্যাকবার্নকে ভাষা ফিরিয়ে দেওয়ার দূত হিসেবে অভিহিত করেন বিভিন্ন সময়ে। হুইল চেয়ারে বসে স্টিফেনের বিজ্ঞান জয় শুধু বাকশক্তির জন্যই থমকে যেত। কিন্তু সহযোগী বন্ধুসুলভ ব্ল্যাকবার্নের একান্ত চেষ্টায় স্টিফেনের বিজ্ঞান গবেষণাকে অবিচল রাখার প্রেরণা জুগিয়েছে।

নিত্যনতুন বিজ্ঞান তত্ত্ব নিয়ে পৃথিবীকে স্বপ্ন দেখান স্টিফেন। অন্যদিকে স্টিফেনের বাকশক্তি ধরে রেখে বিজ্ঞানকে মানুষের জন্য আরও সহজবোধ্য করার স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছেন আরেক বিজ্ঞানী স্যাম ব্ল্যাকবার্ন।

No comments

Powered by Blogger.