পুরান ঢাকার কষ্টগাথা-বসবাসের অযোগ্য পুরান ঢাকার বঞ্চনার ইতিহাস শত বছরের by আপেল মাহমুদ

ভালো নেই পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দারা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও পুরান ঢাকা অবহেলিতই থেকে গেছে। ফলে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে এখন অনেকেই পালানোর পথ খুঁজছে। কেউ কেউ অন্যত্র আশ্রয়ও নিয়েছে। আর এ জন্য পুরান ঢাকার মানুষ দায়ী করছে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের। বলছে, ঢাকার আদি বাসিন্দাদের মধ্য থেকে মেয়র, এমপি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হলে তাঁদের আর কোনো সমস্যা থাকবে না।


ঢাকার সরদার মাওলা বঙ্রে ছেলে আজিম বঙ্ বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) এবং স্থানীয় এমপিদের উদাসীনতার কারণেই পুরান ঢাকার এ হাল হয়েছে। তাঁরা সবাই পুরান ঢাকাকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর ঢাকা শহর উন্নয়ন পরিকল্পনা করছেন। এ ক্ষেত্রে আদি বাসিন্দারা মেয়র কিংবা এমপি হলে তা হতো না। কারণ পুরান ঢাকা হলো তাঁদের নাড়ি। এ নাড়ির টানে হলেও তাঁরা নিজ আবাসস্থলকে বসবাসের যোগ্য করে তুলতেন।
পুরনো ইতিহাস থেকে জানা যায়, অতীতে বুড়িগঙ্গার উত্তর তীর ঘেঁষে বাকল্যান্ড বাঁধকে কেন্দ্র করে অভিজাত মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল। ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিজাত ধনাঢ্য জমিদার ও ব্যবসায়ীরা সেখানে মনোরম বাড়ি-ঘর, বাগান নির্মাণ করে বসবাস করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ঢাকা নগরীর পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এ জৌলুস ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
বঞ্চনার ইতিহাস অবশ্য অনেক পুরনো। ১৮৬৩ সালে ঢাকা প্রকাশ পত্রিকায় বলা হয়, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কসাইদের আস্তানা, বন-জঙ্গল বৃদ্ধি এবং ময়লা-আবর্জনার কারণে শহরের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর শাহবাগ, পল্টন, সেগুনবাগিচাকে ঘিরে পরিকল্পিত নতুন শহর তোলা হলেও পুরান ঢাকা আগের মতোই অপরিকল্পিত অবস্থায় থেকে যায়। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা সেই ব্রিটিশ আমলের আদলেই রয়ে যায়। ১৯১৭ সালে প্যাট্রিক গেড্ডেসের 'ঢাকা নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা', নগর উন্নয়নে ১৯৫৬ সালে 'ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট', ১৯৫৮ সালে ব্রিটিশ পরামর্শক সংস্থার 'মহাপরিকল্পনা', ১৯৬৪ সালে লুই আই কানের দ্বিতীয় রাজধানী পরিকল্পনা এবং সম্প্রতি 'বিস্তারিত নগর পরিকল্পনা' (ড্যাপ) নিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়ানো হলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরান ঢাকাকে এসবের বাইরে রাখা হয়েছে।
উন্নয়ন পরিকল্পনায় যে পুরান ঢাকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না তা স্বীকার করেন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ডিসিসি থেকে কখনো পুরান ঢাকার ব্যাপারে আলাদা পরিকল্পনা কিংবা বাজেট করা হয়নি। সমগ্র ঢাকার বাজেট করতে গিয়ে বরং পুরান ঢাকার বাজেট কম করতে হয়। এর কারণ হলো, মোগল ব্রিটিশ যুগের বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ভেঙে নতুন করে সাজানো নয়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা এবং বড় ধরনের বাজেট দরকার। ডিসিসির তেমন বাজেট নেই। দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাওয়া ঢাকা শহরের বাজেট করতে গিয়ে ডিসিসিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পুরান ঢাকার পথঘাট সংস্কারের চেষ্টা সব সময় করা হয় দাবি করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে রাজউক থেকে মাস্টারপ্ল্যান করা হলে হয়তো পুরান ঢাকাকে পরিকল্পিত এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি মনে করেন, ঐতিহাসিক মূল্যায়নের জন্য পুরান ঢাকাকে নতুন রূপে সাজানোর বিকল্প নেই।
নগরবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, পৃথিবীর যেকোনো পুরান শহর ৫০ কিংবা ১০০ বছর পরপর নতুন পরিকল্পনায় সাজাতে হয়। কিন্তু পুরান ঢাকার বয়স ৪০০ বছর হয়ে গেলেও কখনো এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে সেখানে বর্তমানে সুষ্ঠু কোনো নাগরিক পরিবেশ নেই। তিনি সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে পুরান এলাকা সাজানোর জন্য নতুন পরিকল্পনায় স্থাপনা নির্মাণ করা হয় সরকার এবং বাড়ির মালিকদের সহযোগিতায়। কিছু কিছু পুরনো বাড়ি কিংবা স্থাপনা সংরক্ষণ করা হয় মডেল হিসেবে, যার মাধ্যমে নগরীর প্রাচীনত্ব প্রমাণ করা যায়।
ড. নজরুল ইসলাম আরো বলেন, ইতিপূর্বে রাজউক থেকে পুরান ঢাকার ব্যাপারে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হলেও কোনো কাজে আসেনি। কারণ, রাজউককে দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। পুরান ঢাকার বাড়িওয়ালারা তাদের সম্পত্তি রাজউকের কাছে নিরাপদ মনে করেনি বলেই পরিকল্পনা শুধু খাতা-কলমে রয়ে গেছে।
সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, বর্তমানে পুরান ঢাকার বহু মানুষ তাদের আদি বাসস্থান ছেড়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ শুধু ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে সেখানে যাতায়াত করে। কলতা বাজারের আদি বাসিন্দা ফারুক আহমেদ বলেন, মহল্লার পর মহল্লা ঢাকাইয়া শূন্য হয়ে যাচ্ছে। তিনি নিজেও পৈতৃক বাড়িঘর ছেড়ে শাহবাগের দিকে ফ্ল্যাটে বসবাসের চিন্তা করছেন। কারণ ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলতা বাজার থেকে সিদ্ধেশ্বরী, ভিকারুননিসা স্কুলে ছয় কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লাগে তিন-চার ঘণ্টা।
পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্লট ছোট হওয়ায় দুই কাঠার বাড়িতে গাদাগাদি করে ১০-১২টি পরিবার পর্যন্ত থাকতে হয়। রাস্তাঘাট নেই বলে ছোট ছোট প্লটে উঁচু ভবন তৈরির অনুমোদন দেয় না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আবার অনেকে আর্থিক কারণে বহুতল ভবন নির্মাণও করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার কোনো কোনো পঞ্চায়েত কমিটি এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। কলতা বাজার পঞ্চায়েত কমিটি ছোট ছোট প্লট মালিকদের বহুতল বাড়ি নির্মাণের জন্য আর্থিক সহযোগিতা করছে। তাঁতী বাজারের আদি বাসিন্দা চন্দন কুমার রায় বলেন, এ দায়িত্বটা মেয়র কিংবা স্থানীয় এমপিদের নেওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা এসব নিয়ে কখনো চিন্তা-ভাবনা করেন না।
পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দাদের এখন সংখ্যালঘু হওয়ারও জোগাড় হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসা করতে এসে অনেকে জায়গা-জমি কিনে পুরান ঢাকায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, লালবাগ, হাজারীবাগ, বংশাল, গেণ্ডারিয়া থানা এলাকায় বসবাসরতদের মধ্যে আদি ঢাকাইয়ারা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। শ্যামবাজার, গেণ্ডারিয়া, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী, মিটফোর্ড, বাদামতলী ঘাট এলাকায় বিক্রমপুর, কাপ্তান বাজার, বিসিসি রোড ও বনগ্রাম এলাকায় কিশোরগঞ্জ, বাংলাবাজারে নরসিংদী, সদরঘাটে বরিশাল, জিন্দাবাহার লেনে মানিকগঞ্জ এবং নয়াবাজার এলাকায় নোয়াখালী জেলার মানুষের সংখ্যা বেশি।
পুরান ঢাকার এ দুরবস্থার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ওয়ারী ও গেণ্ডারিয়া ছাড়া পুরান ঢাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। তা ছাড়া শহরের সর্বত্র পাইকারি বাজার, ব্যবসা কেন্দ্র, বিপণিবিতান, কল-কারখানা মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোর্ট-কাচারি, জেলখানা, ট্রেজারি অফিস ও নদীবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে নেই কোনো বিনোদনকেন্দ্র, খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা মিলনায়তন। শাবিস্তান, রূপমহল, লায়ন, তাজমহল, গুলিস্তান, নাজসহ আরো কিছু সিনেমা হল বন্ধ করে দিয়ে সেসব জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক বিপণিবিতান। নাজিরা বাজারের বাসিন্দা রিয়াজউদ্দিন আহমেদ জানান, পুরান ঢাকার কোথাও একটু খালি জায়গা পাওয়া গেলেই সেখানে উঠে যায় বড় বড় স্থাপনা।
আরমানিটোলার বাসিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাইফুল ইসলাম নভেল বলেন, পুরান ঢাকার সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো একসঙ্গে মানুষ আর দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্যের অবস্থান। যেকোনো সময় নিমতলীর চেয়েও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে আরমানিটোলা, মাহুতটুলী, বংশাল কিংবা মিটফোর্ড এলাকায়। উচ্চ আদালত পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের গোডাউন ও কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইসলামবাগ এলাকার প্রায়ই বাড়িতে প্ল্যাস্টিক ও রাবারজাতীয় দ্রব্যের কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ইসরাত পারভিন বলেন, আগুনভীতির জন্য অনেক সময় রাতে ঘুম আসে না। স্থানীয় বাসিন্দা হামিদা বানু আক্তার বলেন, 'গ্রামের বাড়ির সব জমিজমা বিক্রি করে ইসলামবাগে তিন কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেছি। কিন্তু এখন আগুনের ভয়ে এ বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি।'
অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মোহাম্মদ দিদারুল আলম চৌধুরী বীরপ্রতীকের এক বিবরণ থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকার অর্থনৈতিক গতিকে থামিয়ে দিচ্ছে অব্যাহত যানজট। সরু ও আঁকাবাঁকা রাজপথ ও অলিগলির কারণে শহরের গতি যেন স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ৪০০ বছরের পুরনো অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়েই যেন সব কিছু চলছে, যা আধুনিক শহরের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। তা ছাড়া পুরান ঢাকার ক্রমবর্ধমান বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা এবং জনসংখ্যার চাপ সরু রাস্তাঘাটগুলো আর ধারণ করতে পারছে না। এ কারণে অনেক ঢাকাইয়া এখন আর নিজ এলাকায় বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন ঢালী কালের কণ্ঠকে দুঃখ করে বলেন, 'হয়তো অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করি। কিন্তু শখ হলেও ভালো একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে পারি না। গাড়ি নিয়ে রওনা দিলে গুলিস্তান পেঁৗছাতে দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। আর হেঁটে রওনা দিলে লাগে আধা ঘণ্টা।
ঢাকার আদি বাসিন্দা মেজর (অব.) শরাফত হোসেন বলেন, ঢাকাইয়ারা দিন দিন সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে এ কথা ঠিক। কিন্তু ঢাকাইয়াদের বাদ দিয়ে ঢাকার কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে পুরান ঢাকাকে নতুন করে সাজানোর ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রথমে রাস্তাঘাট চওড়া এবং উড়াল সড়ক নির্মাণ করে যানজট কমাতে হবে। তা ছাড়া পুরান ঢাকার জরাজীর্ণ বাড়িঘর ভেঙে উন্নয়ন করলে খালি জায়গা পাওয়া সম্ভব। সেখানকার মাটি সলিড বলে ২০-৩০ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যাবে। তিনি এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে ঢাকাইয়াদের শিক্ষিত করে তোলার ওপরও জোর দেন।
বংশালের আদি বাসিন্দা কমরুদ্দিন আহমদ বলেন, পুরান ঢাকার কথা শুনলে ট্যাঙ্ওিয়ালা পর্যন্ত সেখানে আসতে চায় না। আদি ঢাকাইয়া এবং ৬১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি আলতাফ হোসেন মনে করেন, সরকার যদি কল-কারখানাগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয় তাহলে পুরান ঢাকার পরিবেশ অনেক ভালো হয়ে যাবে। চুড়িহাট্টার আদি বাসিন্দা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ আবদুস সালাম মনে করেন, পুরান ঢাকা না বলে আসল ঢাকা বলা উচিত। কারণ ৪০০ বছর আগে ঢাকা নগরের সূচনা হয়েছিল এখান থেকে।

No comments

Powered by Blogger.