কে তাঁকে মনে রেখেছে?

এত দীর্ঘ সময় খুব কম মানুষই কারাবাস করেছেন। বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ তাঁর জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারত স্বাধীনতা সংগ্রাম বইতে লিখেছেন, ‘আমি ভারতবর্ষের মধ্যে, ভারতবর্ষ কেন, সম্ভবত পৃথিবীর মধ্যে, রাজনৈতিক কারণে সর্বাপেক্ষা অধিক বৎসর যাঁহারা কারাগারে কাটাইয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন সময় কারাগারে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের সাথে কাটাইয়াছি।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। আজন্ম এই সংগ্রামী মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ভারতবর্ষ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নিজ দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।
জীবন-যৌবনের ৩০টি বছর কারাগারে কেটে গেলেও তাঁর বিপ্লব ছিল চিরজাগ্রত। জেলে আটকে রেখে তাঁর বিপ্লবী মনোভাবকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। কখনো তিনি যোদ্ধা, কখনো গুপ্তচর।
খ্যাতিমান এই বিপ্লবীকে এখন আর কজনা মনে রেখেছেন? এমনকি তাঁর মতাদর্শের রাজনৈতিক মঞ্চেও তাঁর নামটি উচ্চারিত হয় না। মনে রাখার প্রয়োজন অনুভব করে না নিজ জেলা কিশোরগঞ্জ। গ্রামের বাড়ি কুলিয়ারচরবাসীরও ভোলা মন।
আগামীকাল ৯ আগস্ট কীর্তিমান এই ব্যক্তির মৃত্যুদিবস। ৪০ বছর আগের এই দিনে রাজনৈতিক কারণে লম্বা সময় কারাভোগকারী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ ভারতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দেড় মাস আগে ১৯৭০ সালের ২৪ জুন চিকিৎসার জন্য ভারতে যান তিনি। নিজ দেশ থেকে যাওয়াটা সম্মানের না হলেও ভারতবাসী তাঁকে গ্রহণ করেন সম্মান ও শ্রদ্ধায়। আনুষ্ঠানিক সম্মান জানাতে ২৫ জুলাই কলকাতা পৌরসভা আয়োজন করে নাগরিক সংবর্ধনার। সম্মান জানাতে পিছিয়ে থাকেনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও। তৎকালীন ইন্দিরা সরকার ৬ আগস্ট পার্লামেন্টে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। ৮ আগস্ট মহারাজের সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের বহু মন্ত্রী, লোকসভার সরকারি ও বিরোধী পক্ষের অনেক সাংসদের উপস্থিতি ভোজসভাটিকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। বিরল সম্মান পেয়ে বাসায় ফেরার পর থেকে মহারাজ শারীরিকভাবে অসুস্থ অনুভব করতে থাকেন। রাত তিনটার পর মহানায়কের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ সেদিন শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। এর প্রমাণ মেলে পরদিন ১০ আগস্ট। মহারাজের মরদেহ নিয়ে কলকাতায় যে শোকযাত্রা বের হয়, তাতে লাখো ভক্ত ও রাজনৈতিক অনুসারীর উপস্থিতি ঘটে। পরে চোখের জলে কলকাতার কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
মহারাজের বিপ্লবী চেতনার বিষয়টি আপামর জনসাধারণের জানা নেই। তবে রাজনীতিক, সমাজ সংস্কারক ও প্রগতিশীল সমাজকর্মীদের চোখে মহারাজকে ভারতবর্ষের আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ বিপ্লবীদের এখনো উজ্জীবিত করে। মহারাজ পৃথিবীতে আসেন ১৮৮৯ সালে। জন্ম হাওরবেষ্টিত কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার নিভৃত পল্লি কাপাসাটিয়ার সাধারণ একটি পরিবারে। সালটি মনে থাকলেও তারিখটি কারও জানা নেই।
পিতা দুর্গাচরণ চক্রবর্তী ও মা প্রসন্নময়ী দেবীর পরিবারে ত্রৈলোক্যনাথ ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।
১৯০৮ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে কারাবাসের ৩০টি বছর ছিল মহারাজের জন্য কঠিন পরীক্ষা। পরীক্ষার এখানেই শেষ নয়, পাঁচ বছর তাঁকে গুপ্ত জীবন কাটাতে হয়। তা ছাড়া একই কারণে ১৯১৪ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হয়।
মহারাজের ছাত্রজীবন শুরু হয় মালদহ জেলার কানসাটে। ১৯০৬ সালে তিনি বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাশের কাছ থেকে স্বদেশি মন্ত্রের দীক্ষা গ্রহণ করেন। পলাতক জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহারাজ লিখেছেন, ‘পান্তাভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিন বছর পর বাড়ি ফিরি। মাত্র দশ দিন বাড়ি থাকার পর আবার শুরু সুদীর্ঘ পলাতক জীবন। তিন পয়সার ছোলা খেয়ে পঁচাশি মাইল পথ হেঁটে নিরাপদ আশ্রয় পাই।’
মহারাজের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় আসে দেশ বিভাগের সময়। সে সময় অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে পাড়ি জমায়। মহারাজ এ কাজটি করেননি; বরং হিন্দুরা যেন দেশত্যাগ না করে, সে বিষয়ে জেলায় জেলায় গিয়ে প্রচারণা চালান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁর এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভালো চোখে দেখেনি। সন্দেহ থেকে তাঁর চিঠিপত্র পর্যন্ত জব্দ করে। জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারত স্বাধীনতা সংগ্রাম বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় দেশপ্রেমিক এই মানুষটিকে পাকিস্তান সরকার দুই বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখে।
সে সময় বিপ্লবী পুরুষটি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। স্বাস্থ্যহানি ঘটে। কারা কর্তৃপক্ষ কারাগারে মহারাজের মৃত্যুর আশঙ্কা করে কিছুটা ভীত হয়ে পড়ে। দায় এড়াতে তড়িঘড়ি মুক্তি দেয় নেতাকে। উন্নত চিকিৎসার জন্য অনুসারীরা নেতাকে ভারতে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু সরকারের দিক থেকে অনুমতি মেলেনি। বহু আবেদন আর জনতার চাপ—সর্বোপরি ভারত সরকারের আগ্রহের কারণে ১৯৭০ সালের মে মাসে তিন মাসের জন্য তাঁর পাসপোর্ট মঞ্জুর করে সরকার। ১৯৭০ সালের ২৪ জুন মহারাজ খুব সকালে বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
তাঁর নিজ উপজেলা কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে ১০ বছর আগের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ নামের একটি গণগ্রন্থাগার ছাড়া আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। সেটিও হয়েছে এক সরকারি কর্মকর্তার হাত ধরে। সে সময় কুলিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহারাজের স্মৃতি ধরে রাখার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ার পর গ্রন্থাগারটিও মুখ থুবড়ে পড়ে।
জীবনের মূল্যবান সময় দিয়ে যে মানুষটি দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন, সেই মানুষটিকে আমরা কতটুকু মনে রেখেছি? প্রশ্নটি তাঁর রাজনৈতিক অনুসারী থেকে শুরু করে প্রগতিশীল চিন্তার মানুষের কাছে এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারত স্বাধীনতা সংগ্রাম
সুমন মোল্লা
sumon.mollah@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.