যখন তোমার পা-ই তোমার পাসপোর্ট by ফারুক ওয়াসিফ

সরকারের নড়াচড়ার আগেই মানুষ নড়াচড়া শুরু করেছে। বাংলাদেশের জলবায়ু-শরণার্থীদের পায়ে পায়ে শুরু হয়ে গেছে বিশ্বের বৃহৎ ও দীর্ঘতম এক অভিবাসন। উপকূলীয় দুর্গতরা নিজ নিজ বসতি ছেড়ে কেউ উঠেছে বাঁধের ওপর, কেউ এসে পড়েছে ঢাকার কড়াইল বস্তিতে, কেউ মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধে। খুলনা ও চট্টগ্রামেও তারা পৌঁছে যাচ্ছে। কেউ পাড়ি দিচ্ছে সীমান্ত। যারা পারছে তারা মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন সমীক্ষা ও স্থানীয়জনপ্রতিনিধিসূত্রে জানা যাচ্ছে, সাতক্ষীরার গাবুরা ইউনিয়নের অর্ধেক মানুষই এলাকা ছেড়ে যে যেদিকে পারে চলে গেছে।
হাজার বছর ধরে আর্য-দ্রাবিড়, আরব-মুঘল-পাঠান ও ইংরেজকে আশ্রয় দিয়েছে বঙ্গ। আজ বঙ্গবাসীর অনেকেই মরিয়া হয়ে হাঁটা দিচ্ছে আর্যদের দেশে, আরবদের দেশে, ইউরোপীয়দের দেশের দিকে। নভোযান যেমন পৃথিবী ছাড়ার আগে কক্ষপথে কয়েক পাক ঘুরে দূরের গ্রহ-তারার দিকে ছুটে যায়, তারা তেমনি ঘোরা শুরু করেছে স্বদেশের পথে পথে। তাদের পায়ে পায়েই শুরু হয়ে গেছে পাল্টা এক বৈশ্বিক অভিবাসন। নতুন করে উঠছে পুরোনো সেই স্লোগান: তোমার পা-ই তোমার পাসপোর্ট, তোমার হাতই তোমার কর্মের অধিকার, তোমার অধিকারই তোমার ভিসা, তোমার সন্তানই নতুন মানবতা।
প্রাচীনকাল থেকে কয়েক শতক আগে পর্যন্ত বঙ্গীয় বদ্বীপ গ্রহণ করেছিল চারটি বড় অভিবাসনের স্রোত। বাংলা ছিল সভ্যতার ফ্রন্টিয়ার জোন বা সীমান্ত অঞ্চল—যার পরই সাগর ও অরণ্য। আরব বণিক ও ধর্মপ্রচারকেরা এসেছিল, এসেছিল ভাগ্যসন্ধানী তুর্কি সেনা ও সুফিরা, তারও আগে জয় করতে এসেছিল আর্যরা, সবার শেষে আসে ইংরেজ। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও গঙ্গা পেরিয়ে এদিকে পা রাখে। গঙ্গা নদী পূর্বদিকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গে বসতি স্থাপন এবং কৃষির বিস্তারও বেগবান হয়।
এই অভিবাসী স্রোতধারার বড় অংশই এখানকার মাটি ও মানুষের মধ্যে মিশে যায়। কম জনবসতিপূর্ণ কিন্তু উর্বর বাংলার আকর্ষণ কেইবা এড়াতে পেরেছিল? সেকালে ‘অভিবাসী’ বা ‘শরণার্থী’ নামক ধারণার জন্ম না হলেও এই ভূখণ্ডের শিথিল ও উদার সমাজকাঠামো বহিরাগতদের গ্রহণে বাধা দেয়নি। মুসাফির বা অতিথির বিশেষ অধিকার সেই সমাজে ছিল। এর সুবাদে সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিরাট এক মিশ্রণ-মঞ্চ হতে পেরেছিল বাংলা। আজ আমেরিকা নিজেকে যে অর্থে ‘মেল্টিং পট’ বলে থাকে, তার থেকেও অনেক মানবিক ও সমৃদ্ধ ছিল বাংলার বহুজন জাতির মিশ্রণ-প্রক্রিয়া।
আজ প্রতিদান চাইছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের চাপে নিচের থেকে ওপরের দিকে, পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখে আরেকটা অভিবাসন-যাত্রা (এক্সোডাস) শুরু হয়ে গেছে। সিডর-আইলার দুর্গতরা, ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার শিকারেরা, নদীভাঙন ও খরায় বিপন্নরাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিচিত্র অভিঘাতে অজস্র পেশার অজস্র মানুষ তাদের বসতি ও পরিজন ছেড়ে বের হয়েছে পৃথিবীর পথে। ঢাকার মিরপুরের বস্তিতে, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধে তারা আছে। খুলনা ও চট্টগ্রামের বস্তিতে নতুন আসা মানুষদের সারিতেও তারা দাঁড়িয়ে। তাদের বেশির ভাগই ছিল কৃষক-কারিগর বা জেলে, এখন তারা ছিন্নমূল মানুষ মাত্র।
বড় বড় নগরে তারা আসছে। সামান্য আশ্রয় নিয়ে নগর-দরিদ্রদের সঙ্গেও যখন তাদের সংঘাত ঘটবে, রাজনীতি ও রাষ্ট্র যখন তাদের বন্দোবস্ত দিতে ব্যর্থ হবে, তখন এটা পরিণত হবে জাতীয় সমস্যায়। আর আজকের দুনিয়ায় যাহাই জাতীয় তাহাই আন্তর্জাতিক। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যসহ ধনী দেশগুলোকে বাংলাদেশের দুর্গতদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। স্পষ্ট কথায়, যারা প্রকৃতিকে চুষে-খেয়ে জলবায়ু বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে, বিপন্নদের দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। এটা তাদের ঔপনিবেশিক শোষণের দায়ও বটে। এই দায় অস্বীকার করা রাজনৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল, গণবিরোধী ও নীতির দিক থেকে অনৈতিক।
কেবল তো দিনের শুরু, দিনের শেষে প্রাকৃতিক সমস্যা সার্বিক রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সংকটের জন্ম দিতে বাধ্য। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এই জলবায়ু-শরণার্থীদের সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বিশ্বের প্রতি ৪৫ জনের মধ্যে একজন এবং বাংলাদেশের প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার হবে। সমুদ্রের উচ্চতা এক মিটার বাড়লেই দেশের ২০ শতাংশ এলাকা ডুবে যাবে। একদিকে হিমালয়ের বরফ গলা পানি, অন্যদিকে সমুদ্রের নোনা প্লাবণে আক্রান্ত হবে আরও বেশি এলাকা। অতি বন্যা, অতি বৃষ্টির পাশাপাশি চরম খরা ফিরে ফিরে আসবে। ধানের উৎপাদন কমে যাবে অর্ধেক। নতুন রোগ-মহামারির আক্রমণ ও জীবব্যবস্থার নৈরাজ্যের সামনে রক্ষাকবচ হারাব আমরা। খাদ্য-নিরাপত্তা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে আরও বেশি মানুষ। এত মানুষের উপায় দেশের ভেতর থেকে করা সম্ভব না। যাওয়ার কোনো পথও থাকবে না। মুশকিল হলো, আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও কনভেনশনগুলো রাজনৈতিক শরণার্থী ছাড়া অন্য কোনো শরণার্থীর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। কাদের বলা হবে জলবায়ু-শরণার্থী, সে ব্যাপারেও সবাই একমত নয়। স্পষ্ট কথায় বাংলাদেশের এত মানুষের ভার কেউ নেবে না। কাজে কাজেই কোটি কোটি মানুষ নিজ সীমানার মধ্যেই বন্দী হয়ে পড়বে।
এমনিতেই দেশ জনসংখ্যার ভারে কুঁজো; সম্পদ, জমি ও সুযোগের চরম টানাটানি। রাষ্ট্র-প্রশাসন ও রাজনীতি গণবিরোধী, অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও জনস্বার্থ-বর্জিত। যখন সব দিকেই আকাশ ভেঙে পড়বে আর সমুদ্র করবে তোলপাড়, তখন সীমিত সুযোগ নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হবে। যাদের নেই তারা যাদের আছে তাদের ওপর হামলে পড়বে। এই চরমভাবাপন্ন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে লতিয়ে লতিয়ে বাড়বে রাজনৈতিক হানাহানি, সন্ত্রাস ও দাঙ্গা। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকেও তা উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। ভারতের আশঙ্কা, অন্তত কোটি সংখ্যক মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে সে দেশে যাত্রা করতে পারে। তাদের মোকাবিলার জন্য তারা আগাম কাঁটাতারের বেড়া এবং সন্ত্রাস দমনের সামর্থ্য সৃষ্টি করছে। এমনিতেই ভারতের বিপুল দারিদ্র্য সেখানে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে। এসব কারণে ভারত নিজের স্বার্থেই সব উপায়ে এই মানুষদের ঠেকিয়ে রাখবে। ভারতের সীমান্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও জোরদার করার সাম্প্রতিক তোড়জোড়কে এভাবেও পাঠ করা যায়।
সুতরাং আমাদের ল্যাঠা আমাদেরই সামলানোর কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যমান পরিবেশ ও মানুষবিনাশী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বদলানো ফরজ। সবচেয়ে বড় পরাশক্তি যে প্রাকৃতিক নিয়ম, তাকে মান্য করে নতুন করে শুরু করতে হবে সবকিছু। তার আগে দরকার হবে একটি নতুন আইন, যার সুবাদে বাংলাদেশের জলবায়ু-শরণার্থীরা আন্তর্জাতিক স্তরে তাদের অধিকার নিয়ে হাজির হতে পারবে। বাংলাদেশকে বিশেষ করে এই দুর্গতদের জীবন-জীবিকা-বাসস্থান ও নিরাপত্তার বিশেষাধিকার স্বীকার করতে হবে। তাদের বিশেষ স্ট্যাটাস দেওয়ার পরই আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে সেই স্ট্যাটাসের স্বীকৃতির জন্য কাজ করে যেতে হবে। এমনকি খসড়া হিসেবে প্রণীত অভিবাসন আইনেও জলবায়ু-দুর্গতদের জন্য বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেসব দেশের উদ্বৃত্ত জমি ও সম্পদ আছে, তাতে এসব মানুষকে পুনর্বাসনের সুযোগ দিতে হবে। জলবায়ুবিপন্ন পৃথিবীতে এটাই হবে ন্যূনতম মানবিক অধিকার, যা বাস্তবায়িত না হলে অন্যান্য অধিকারও বিশেষ কোনো অর্থ বহন করবে না। উদ্যোগী হলে এই কাজে অন্যান্য জলবায়ুবিপন্ন দেশের সমর্থনও আমরা পাব। আন্তর্জাতিক জনমতও সহানুভূতিশীল। সবার সম্মিলিত স্বার্থে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক আইন সংশোধন তাই জরুরি। এ ক্ষেত্রে ব্যথা যার, চিৎকারটা তাকেই করতে হবে।
সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন নিয়ে কাজ করছে। আধুনিক রাষ্ট্র ও অর্থব্যবস্থায় সবকিছুকেই ম্যানেজারিয়াল চোখে দেখা প্রায় বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যাটা যখন বুনিয়াদি, তখন ব্যবস্থাপনার খুটখাট নিয়ে মেতে থাকা সমস্যাকে আড়াল করার শামিল। হাত দিতে হবে সমস্যার গোড়ায়। সে জন্য বিশ্বের বর্তমান রাজনীতি ও অর্থনৈতিক পদ্ধতি বদলাতে হবে, তেমনি জলবায়ু-দুর্যোগের সাপেক্ষে মানবাধিকারের আওতা ও ধারণা এবং আন্তর্জাতিক আইন-আদালতকেও নতুন করে সাজাতে হবে। জলবায়ুবিপন্নদের বৈধ জলবায়ু-শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া এবং তাদের পুনর্বাসনের দাবিকে ন্যায্য অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা তাই জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
এই পৃথিবী আমাদের একমাত্র তরী, একে কেটে ভাগ করে চ্যালা কাঠ বানিয়ে রাখা অপরাধ। যাদের মাটি শুকনো, ডুবন্ত মানুষকে তাদের ডাঙায় উঠতে দিতেই হবে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর গতিক দেখে মনে হয়, নিজেদের নাকের ডগার থেকে বেশি দূর তারা দেখতে পান না। তাঁরা বাঁচলেই মানুষ বাঁচবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.