শুদ্ধ জাতীয় সংগীত নিয়ে কর্মশালা by গাজীউল হক

আজকাল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভুলভাবে, ভুল উচ্চারণে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। এ নিয়ে সব মহলেই হতাশার কথা শোনা যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কুমিল্লায় আয়োজন করা হয় এক কর্মশালার। কুমিল্লার সামাজিক সংগঠন অধিকার ফাউন্ডেশন ওই কর্মশালার আয়োজন করে। শুদ্ধ জাতীয় সংগীত পরিবেশন শিরোনামের কর্মশালাটি ২৪ মার্চ কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপী আয়োজিত ওই কর্মশালায় কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অংশ নেন। তাঁরা প্রত্যেকেই মহিলা শিক্ষক। বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরুর আগে অ্যাসেম্বলিতে তাঁদের নেতৃত্বেই শিক্ষার্থীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষকেরা যেন শুদ্ধ জাতীয় সংগীত পরিবেশন করতে পারেন, সে জন্যই ওই কর্মশালা—জানালেন আয়োজকেরা।
কর্মশালার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অধিকার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আলী আকবর মাসুম জানান, মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস। এ মাসকে কেন্দ্র করে তথা স্বাধীনতার ৪০ বছর উপলক্ষে ওই কর্মশালা করা হয়। এতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেছে নেওয়া হয়। শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেই শিক্ষার্থীদের অ, আ, ক, খ-সহ বর্ণমালা শেখানো হয়। জাতীয় সংগীতও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের রপ্ত করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা এ সম্পর্কে অজ্ঞ। তাঁদের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে ধারণাও স্পষ্ট নয়। আর যাঁরা শেখাচ্ছেন, তাঁদেরও রয়েছে কিছু দুর্বলতা। আর যাঁরা পারেন, তাঁদের ওই পারাটাকে আরও বিকশিত করার জন্য ওই কর্মশালার আয়োজন। দিনব্যাপী ওই কর্মশালায় প্রশিক্ষক ছিলেন কুমিল্লার সংগীতাঙ্গনের প্রিয় মুখ অমল কুমার সিনহা, অভিজিৎ সিনহা মিঠু ও শিপ্রা সরকার। তাঁরা একে একে সব ভুল ধরিয়ে দেন। বাতলে দেন লাল-সবুজের পতাকার প্রিয় সংগীতের ভাবার্থ। সুর, তাল ও লয় নিয়ে কথা বলেন।
সকাল নয়টায় ওই কর্মশালা শুরু হয়। এতে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একে একে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। পরিবেশনের পর প্রত্যেক শিক্ষকের ভুলত্রুটি সংশোধন করে পুনরায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। এরপর জাতীয় সংগীতের শুদ্ধ উচ্চারণ, জাতীয় পতাকার তথ্য পরিচিতি সম্পর্কে শিক্ষকদের ধারণা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে কথা বলেন সাপ্তাহিক অভিবাদন পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসানাত বাবুল। তিনি শিক্ষাঙ্গনে সঠিক মাপের পতাকা টানানো, শুদ্ধ জাতীয় সংগীত চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পতাকা ও সংগীতে তারুণ্যের উদ্দীপনা এবং চিরায়ত বাংলার রূপ রয়েছে। আমরা যেন কখনো একে অবমাননা না করি।’
কর্মশালায় গুলবাগিচা, বিষ্ণুপুর, মনোহরপুর, লতিফা নিরোদা সুন্দরী, গোবিন্দপুর, আড়াইওড়া, আড়াইওড়া পূর্ব, শাসনগাছা, চাঁদপুর, সৈয়দপুর, কমলাপুর, কালীরবাজার, ধনুয়াইশ, হাতীগাড়া, কৃষ্ণনগর, হারুন, রেয়াজউদ্দিন, কাঁটাবিল, বজ্রপুর, রত্নাবতী, উত্তর রসুলপুর, কোটেশ্বর, মুন্সীবাজার, চাঁদপুর, বালুতুপা, ঝাঁকুনিপাড়া, রঘুপুর, অরণ্যপুর ও কালিকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩০ জন শিক্ষক অংশ নেন।
কর্মশালায় অংশ নেওয়া কালীরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক স্নিগ্ধা রানী রায় বলেন, ‘কর্মশালায় অর্জিত জ্ঞান আমাদের প্রতিদিনকার কাজে লাগবে। এ ধরনের কর্মশালা একেবারেই ব্যতিক্রম। আমাদের মধ্যে যেসব ত্রুটি ছিল, তা কর্মশালার মাধ্যমে মুছে গেছে।’
বজ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফেরদৌসী আক্তার ও মনোহরপুর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেবেকা পারভীন বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কর্মশালায় প্রথম এসেছি। এখন শিক্ষার্থীদের আরও ভালো করে জাতীয় সংগীত শেখানো যাবে।’
বিকেলে কর্মশালার সমাপনী পর্ব। এ পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রউফ। তিনি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহসভাপতি (ভিপি)। কুমিল্লা অজিত গুহ কলেজের দীর্ঘদিনের অধ্যক্ষ ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি, কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বললেন, ‘জাতীয় সংগীত নিয়ে এমন আয়োজন বিরল ঘটনা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে আমরা জাতীয় সংগীত শুনে বিস্মিত হই। হতবাক হই। তখন দুঃখ পাই, এ জন্যই কি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি? আশা করি, আমাদের সম্মানিত শিক্ষকেরা কোমলমতি শিশুদের শুদ্ধ জাতীয় সংগীত শেখাবেন। তবেই আমাদের স্বপ্ন সার্থক হবে।’
পরে কর্মশালার সনদ বিতরণ করা হয়। কর্মশালায় অংশ নেওয়া শিক্ষকেরা দলীয়ভাবে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। সবশেষে একটি অঙ্গীকার হয়। ওই অঙ্গীকার পতাকার মান রাখার। ওই অঙ্গীকার একসঙ্গে শব্দ করে জাতীয় সংগীত গাওয়ার। এরপর বেলা পড়ে যায়। যেতে যেতে সবার কণ্ঠে আবারও বেজে ওঠে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’।

No comments

Powered by Blogger.