পাকিস্তান নয়, ধোনিদের প্রতিপক্ষ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও!

দৃশ্য এক: পিসিএ স্টেডিয়ামের বাইরে টিকিট কাউন্টারের সামনে শ পাঁচেক লোকের ভিড়। দুই সপ্তাহ আগেই দ্বিতীয় সেমিফাইনাল ‘সোল্ড আউট’ ঘোষণা দিয়ে দেওয়ার পরও কিসের আশায় কে জানে!
দৃশ্য দুই: ধোনিরা ভেতরে প্র্যাকটিস করছেন। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় স্টেডিয়ামের মূল গেট থেকে প্রায় এক মাইল লম্বা গাড়ির লাইন। রাস্তার দুই পাশের গাড়িগুলো সকাল থেকেই ছিল। ডিশ-টিশ লাগানো টিভি চ্যানেলের গাড়ি। সংখ্যায় বিশ ছাড়িয়ে।
দৃশ্য তিন: পাঞ্জাবের উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিং বাদল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চণ্ডীগড় ও মোহালিবাসীকে অনুরোধ করছেন, কেউ যদি এক দিনের জন্য একটা ঘর ছেড়ে দিতে রাজি হন, তা হলে যেন বিশেষ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেন। হোটেলে জায়গা নেই। পাঞ্জাব সরকারের কর্মকর্তারা এরই মধ্যে তাঁদের কোয়ার্টারের একটি করে অতিথিদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।
চাইলে এমন আরও দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজানো যায়। ভারত-পাকিস্তান মহারণ যত এগিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে উন্মাদনা। সুখবীর সিং যথার্থই বললেন, ভারতে এমন কেউ নেই যে বুধবার এখানে থাকতে চায় না। সেই চাওয়া পূরণ হওয়ার জন্য টিকিট চাই। সেটির চেয়ে মহার্ঘ কিছু এই মুহূর্তে শুধু ভারত কেন, ভূ-ভারতেই নেই।
কপিল দেব শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, লোকাল হিরো যুবরাজ সিং না টিকিটের জন্য পরিচিতজনদের অনুরোধের হ্যাপা সামলাতে গিয়ে ম্যাচে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন! ভারতীয় এক ক্রিকেটার ‘আমি একটা টিকিটই দিতে পারি, সেটি দিল্লি থেকে মোহালির বাস টিকিট’ টুইট করেছেন বলে যে শোনা যাচ্ছে, সেটি যুবরাজই হবেন বলে ভারতীয় সাংবাদিকদের অনুমান। পাঞ্জাব ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরা টিকিটের জন্য তদবিরের ঠ্যালায় একরকম গা ঢাকা দিয়েছেন। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শ খানেক লোকের বহর আসছে। তাদের জায়গা করে দিতেই গলদঘর্ম অবস্থা। আইসিসির মিডিয়া কর্মকর্তাও যেমন চোখে সরষে ফুল দেখছেন। মোহালির প্রেসবক্সে ঠেসেঠুসে ৭০ জন বসানো যায়। এই ম্যাচ কাভার করতে আগ্রহী সাংবাদিকের সংখ্যা যে তিন-চার গুণ বেশি!
ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে লেখার প্রথম ২৬৩ শব্দে ক্রিকেটের কোনো নামগন্ধ নেই দেখে বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু কিছু করার নেই। সাংবাদিকের তো আসল পরিস্থিতিটা তুলে ধরারও দায় থাকে। গত দুই দিন সকাল-সন্ধ্যা মোহালির পিসিএ স্টেডিয়ামে কাটানোর অভিজ্ঞতার কতটুকুই বা ক্রিকেট! টিকিট-নিরাপত্তা-ম্যাচের দিন স্টেডিয়ামে পুলিশের সংখ্যা তিন না চার হাজার-দুই প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী-রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আসছেন কি না...এসব আলোচনাই তো বেশি শোনা গেল।
হ্যাঁ, সকাল-বিকেল দুই দলের প্র্যাকটিসের সময় ক্রিকেট কিছুটা থাকল। গত পরশুর মতো কালও সকালে পাকিস্তান, বিকেলে ভারত। তবে ভারতীয় দলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু সাংবাদিকদের চাক্ষুষ দেখাতেই সীমাবদ্ধ থাকল। টেন্ডুলকারের নতুন ব্যাট হাতুড়ি পিটিয়ে ঠিকঠাক করায় ব্যস্ত সবাই—এটা সবাই দেখছে। কিন্তু মোহালিতে কেন হঠাৎ নতুন ব্যাট, এটা জানার কোনো উপায় নেই। কেউ কথা বললে তো!
এই বিশ্বকাপে প্রতিটি দলই অনুশীলন শেষে কাউকে না-কাউকে সংবাদ সম্মেলনে পাঠাচ্ছে। পাকিস্তান যেমন শনিবার মোহাম্মদ হাফিজকে পাঠিয়েছিল। পরশু এলেন মিসবাহ-উল-হক। কাল উমর গুল। ধোনির দল শুরু থেকেই এই প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আসছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আলাদা তাৎপর্যের কথা বাদই দিন, বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল বলে কথা। সেটির এক দিন আগেও ভারতীয় দলের ভাবনা জানার কোনো উপায় নেই। বিশ্বকাপের শুরুতে ভারতীয় সাংবাদিকেরা ‘সব দলই কাউকে না-কাউকে পাঠাচ্ছে, আপনারাও কাউকে দিন’ বলে টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন। মহেন্দ্র সিং ধোনি সটান ‘না’ বলে দেন। এর পর থেকে এই চলছে এবং ভারতের ‘বিশাল প্রভাবশালী’ সংবাদমাধ্যম সেটি মুখ বুজে মেনে নিচ্ছে!
মাঠে প্রতিপক্ষ বদল হচ্ছে, কিন্তু এই বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের জন্য এই একটা প্রতিপক্ষ ধ্রুব হয়ে আছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। ভাবা যায়, ভারতে বিশ্বকাপ নিয়ে এমন মারমার কাটকাট উত্তেজনা, অথচ এখন পর্যন্ত এক দিনও শচীন টেন্ডুলকার বা জহির খান সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেননি। আইসিসিও ঠুঁটো জগন্নাথ, ভারতীয় অধিনায়ক যে ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আসার নিয়মও মানছেন না, সেটি বলার সাহসও নেই। যে চারটি ম্যাচে যুবরাজ সিং ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন, শুধু যুবরাজই এসেছেন সংবাদ সম্মেলনে।
ভারতীয় সাংবাদিকদের মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা গা সওয়া গেছে। কিন্তু অন্য দেশের সাংবাদিকদের কাছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়ে ভারতীয় দল বনাম ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এই লড়াই কম চমকপ্রদ লাগছে না। প্র্যাকটিসে মুখোমুখি হয়ে গেলেও সৌজন্যমূলক ‘হাই-হ্যালো’ পর্যন্ত হচ্ছে না। পরিস্থিতি এমনই বিদ্বেষময় যে, ভারতীয় দলের সঙ্গে নতুন ওটা কাকে দেখা যাচ্ছে, তা জানার জন্য ম্যাসিউরকে ঘিরে ধরছেন সাংবাদিকেরা। এটাকেও অভূতপূর্বই বলতে হবে, একটা দেশের সংবাদমাধ্যম মনেপ্রাণে চাইছে তাদের দল যেন বিশ্বকাপ না জেতে! তা হলে যে আর ধোনিদের ছায়াও মাড়ানো যাবে না। ধোনি নাকি এরই মধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ কাকে বলেছেন, বিশ্বকাপ জিতলে টিভি চ্যানেলে ক্রিকেটারদের ইন্টারভিউ গুডবাই!
হঠাৎ কী এমন হলো যে, একটা দেশের ক্রিকেট দল আর সংবাদমাধ্যম এমন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল! ধোনির সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে এমন এক সাংবাদিক জানালেন, সাংবাদিকদের একটা মহল ধোনির অধিনায়কত্ব খেতে চান, এমন একটা ধারণা থেকেই নাকি ধোনির এমন চরম সিদ্ধান্ত। অনেকে আইপিএলের ভূমিকাও দেখছেন এতে। রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে ক্রিকেটাররা নাকি ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। সিনিয়র এক ভারতীয় সাংবাদিক ‘এমন করলে আরও বেশি গুজবনির্ভর নিউজ হবে’ জানিয়ে ধোনির কাছে সন্ধি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। ধোনি জানিয়ে দিয়েছেন, ওটা কথা বললেও হবে, না বললেও হবে। তিনি এতে থোড়াই কেয়ার করেন।
ভারতীয় সাংবাদিকদের বেশির ভাগই এর সূচনা হিসেবে দেখছেন ২০০৯ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে। অধিনায়কত্ব নিয়ে ধোনির সঙ্গে শেবাগের ঝামেলা চলছে—ভারতের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় এই খবর বেরোনোর পর নটিংহামে ধোনি পুরো দল নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন। লিখিত বিবৃতি পড়ার পর বাধ্যতামূলক সংবাদ সম্মেলন ছাড়া ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বয়কট করার সিদ্ধান্তও জানিয়ে দেন আনুষ্ঠানিকভাবে।
মাঝের দুই বছরে সম্পর্কটা ভালো না হলেও কখনো কখনো ‘একটু কম খারাপ’ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু এই বিশ্বকাপে এসে সেটি একেবারেই ভেঙে পড়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে, পাঠক বা দর্শকদের কথা ভেবে ভারতীয় পত্রপত্রিকা বা টিভি চ্যানেলগুলো যতই ‘ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া’ বলে চিৎকার করুক, মনে মনে বোধহয় মুম্বাইয়ের ফাইনালে ভারতকে না দেখলেই তারা খুশি হয়!
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। নতুন বলতে এটাই!

No comments

Powered by Blogger.