মানবসভ্যতার জন্য দোয়া ও মোনাজাত - মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে বিশ্বমানবতার জন্য দোয়া ও আশীর্বাদ কামনাকে একটি স্বতন্ত্র ইবাদতের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। স্রষ্টার সঙ্গে বান্দার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে দোয়া বা ক্ষমাপ্রার্থনা। দোয়ার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে এবং তাঁর উষ্ণ পরশে ধন্য হতে পারে। ‘দোয়া’ শব্দের অর্থ প্রার্থনা করা, আহ্বান করা, কোনো কিছু পাওয়ার জন্য আকুতি-মিনতি করা প্রভৃতি। দোয়া হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার কথোপকথনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বান্দার সঙ্গে তার মনিবের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যম দোয়া। আল্লাহর কাছে এমনভাবে দোয়া করতে হবে যেন নিজেদের মন ও হূদয় পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। সব সময় আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে তুমি পছন্দও করো, অতএব আমাকে ক্ষমা করো।’
দোয়ার মধ্যে মানুষের ইহকালীন ও পারলৌকিক সফলতা নিহিত। আল্লাহ তাআলা ওই মুহূর্তটিকে অধিক পছন্দ করেন, যখন বান্দা মানবসভ্যতার চরম বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে, তাঁর কাছে মাগফিরাত কামনা করে। বান্দা কীভাবে তার চাহিদার কথা মহান প্রভুর দরবারে উপস্থাপন করবে, এর কৌশল সৃষ্টিকর্তাই শিখিয়ে দিয়েছেন। নিজের কাছে কোনো কিছু চাওয়ার আহ্বান করা এবং এর পদ্ধতি বাতলিয়ে দেওয়ার নজির একমাত্র আল্লাহর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে (তাদের জানিয়ে দাও) নিশ্চয়ই আমি তাদের কাছেই আছি। আহ্বানকারী (প্রার্থনাকারী) যখন আমাকে আহ্বান করে (দোয়া করে), আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই (দোয়া কবুল করি)। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার ওপর ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৬) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বান্দার আহ্বানে সাড়া দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন, ‘অনন্তর তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব; আর তোমরা আমার শুকরিয়া আদায় করো এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৫২)
পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা জীব বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে মানবজাতি সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি বা দাসত্ব করা। স্রষ্টার দিকনির্দেশনা মোতাবেক সঠিক পথে চলাই বান্দার প্রধান দায়িত্ব। প্রভুর সান্নিধ্য অর্জন গোলামের আরাধ্য। আল্লাহ তাআলা মানুষকে অত্যন্ত ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন। তিনি চান মানবসভ্যতা তাঁর দয়া ও করুণার শীতল স্পর্শে ধন্য হোক! রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সিজদায় বান্দা তার প্রভুর অধিক নিকটবর্তী হয়ে থাকে। তাই তোমরা অধিক দোয়া করো।’ (মুসলিম)
আল্লাহ তাআলার অসংখ্য মহান গুণের একটি হলো ক্ষমা। আল্লাহ ‘গাফুরুর রাহিম’ অর্থাৎ তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। মানুষ মহান আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া লাভ করে পাপমুক্ত হতে পারে, সৌভাগ্যবান হতে পারে। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে পাপমুক্তির জন্য দোয়া কীভাবে করতে হবে, এর পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন—ইহকাল ও পরকালের সফলতার জন্য কীভাবে দোয়া করতে হবে, এ মর্মে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে দুনিয়া এবং আখিরাত উভয়ের মধ্যে সফলতা দান করো এবং আমাকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি দাও।’ অন্যত্র দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার নিজের ওপর অত্যাচার করেছি; এখন যদি তুমি আমাকে মাফ না করো এবং আমার ওপর দয়া না করো; তবে নিশ্চয়ই আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’
মুসলমানদের যেকোনো বিপদ-আপদে আল্লাহর রাসুল দোয়ার মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করে তা থেকে মুক্তি লাভ করতেন। মক্কায় অবস্থানকালীন কঠিন মুহূর্তে, ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয়ের মুখে, হিজরতের সময় কাফেরদের হাতে ধরার পড়ার অতিশয় নিকটবর্তী সময়েও নবী করিম (সা.) যখনই আল্লাহর দরবারে দুই হাত উঠিয়েছেন, তখনই আল্লাহর ঐশী সাহায্য এসেছে এবং তাঁর অসীম রহমতের দরজা খুলে গেছে। আল্লাহ তাঁর কৃপার অশেষ রহমত প্রিয় হাবিবের সাহায্যার্থে বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাক বা মানবিক বিপর্যয়ের করুণ মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতিয়ার ছিল দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর মনোযোগ আকর্ষণ করা। গভীর রাতে সমস্ত জগৎ যখন নিঝুমপুরী, সবাই যখন ঘুমে বিভোর, তখনো রাসুলে করিম (সা.) উম্মতের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে কান্নাকাটি করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা (প্রতি রাতে) দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে আসেন এবং ডেকে বলেন, ‘কে আছে এমন যে আমার কাছে নিজের গুনাহখাতা মাফ চাইবে আর আমি মাফ করে দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
দোয়ার আদব হলো বান্দা নিজের সমস্ত দুর্বলতা ও কমজোরি অত্যন্ত বিনম্র ভাষায় আল্লাহর কাছে নিবেদন পেশ করবে। নিজের সমস্ত সত্তাকে আল্লাহর দরবারে বিলীন করে দেবে। নিজের চাওয়া-পাওয়া সবকিছুকে আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেবে। নিজেকে সম্পূর্ণ আল্লাহর দরবারে সোপর্দ করে নিজের চাহিদার কথা, নিজের অভাব-অনটন ও অন্য মানুষের বিপদ-আপদের কথা প্রভুকে জানাবে। অপরাধী যখন অনুশোচনায় সিক্ত হয়, অন্যায় ও অপরাধকর্ম থেকে বিরত হওয়ার প্রতিশ্রুতিতে যখন আল্লাহর দরবারে হাজির হয়, তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন ধরনের লোকের দোয়া কখনো ফেরত দেওয়া হয় না। ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের দোয়া, বাড়িতে ফিরে না আসা পর্যন্ত মুসাফিরের দোয়া।’ (তিরমিজি)
প্রকৃত ও যথার্থ দোয়ার ফল অবশ্যম্ভাবী। সঠিক নিয়মে দোয়া ও মোনাজাত করলে তা কখনো বিফলে যায় না। দোয়ার ফলাফলে বিলম্ব হলেও এতে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। কোনো দোয়ার ফল যদি ইহকালে না পাওয়া যায়, তবে তা পরকালে অবশ্যই পাওয়া যাবে—সবাইকে এ বিশ্বাস রাখতে হবে। সর্বোপরি অন্তরকে স্বচ্ছ ও কলুষতামুক্ত করে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতে পারলেই মানবজীবনে দোয়া কবুলের নিশ্চয়তা রয়েছে। এ জন্য মানুষের জন্য বেশি বেশি করে দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রচেষ্টা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের সব সময় করা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.