উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন কতটা যুক্তিযুক্ত? by ম. ইনামুল হক

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি বড়পুকুরিয়ায় একটি উন্মুক্ত খনি করার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৬২৮ একর ভূমি অধিগ্রহণের তৎপরতা শুরু করেছে। ফলে এলাকাটি ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠছে। এই স্থানে বর্তমানে ছয় মিটার ব্যাসের ৩২৬ ও ৩২০ মিটার গভীর দুটি ধাতুর কুয়া পুঁতে পাতাল থেকে প্রলম্বিত আনুভূমিক সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা তোলা চলছে। তবে China Machinery Export and Import Company (CMC) নামের চীনা কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত এই উত্তোলন চুক্তির মধ্যে একটি বড় ধরনের ত্রুটি আছে; তা হলো, উত্তোলিত কয়লার ভূগর্ভস্থ ফাঁকা জায়গাটি বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে না। এর ফলে ওপরের মাটির চাপে এলাকাটি দুই থেকে তিন মিটার বসে অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পার্বতীপুর উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের একটি বিশাল এলাকা দেবে গিয়ে জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। জনগণ সেখানে দেবে যাওয়া রাস্তার ওপর বাঁশের মাচা নির্মাণ করে (স্থানীয় ভাষায় ‘ধামাল’) যাতায়াত করছে। অনেক আন্দোলনের পর কয়লাখনি কর্তৃপক্ষ স্থানীয় অধিবাসীদের এক প্রকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে আসছিল, কিন্তু ওপেন পিট করার সাম্প্রতিক উদ্যোগের ফলে বিগত আমন মৌসুম থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় জনগণ তাই এসব সরকারি তৎপরতায় অত্যন্ত শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
অপরদিকে এশিয়া এনার্জি বড়পুকুরিয়ায় নতুন করে উন্মুক্ত কয়লাখনি করার প্রস্তাব দিয়েছে। চলতি বছরের ৩১ আগস্ট চীনা কোম্পানির সঙ্গে বড়পুকুরিয়ার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। সরকার প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের নামে তাদের পক্ষ হয়েই জমি অধিগ্রহণের জন্য একরপ্রতি ২০ লাখ টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যাতে গরিব সাধারণ মানুষের জীবিকা ও পুনর্বাসনের জন্য আকর্ষণীয় কিছুই নেই। বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত কয়লাখনি করা সম্ভব হবে কি না, সে ব্যাপারে কোনো সমীক্ষা ছাড়াই এ ধরনের উদ্যোগ সরকারি অর্থের লুটপাট আর বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া ভালো কিছু হবে না। অথচ স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা প্রশাসন উন্নয়নের প্রচার করে এলাকার মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করছে, যার ফলে বিগত ৩১ ডিসেম্বর এবং ২১ ফেব্রুয়ারি এলাকায় সংঘর্ষও হয়েছে। এখন বেশ কিছু স্থানীয় অধিবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
বড়পুকুরিয়ায় ওপেন পিট মাইনিংয়ের সম্ভাবনার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন (ডেইলি স্টার, ১১.০৪.২০১০)। জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এর পর বলেন, বড়পুকুরিয়ায় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে উন্মুক্ত খনি করার প্রস্তাব করা হচ্ছে (ডেইলি স্টার, ২৯.০৫.২০১০)। পরের মাসে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেন, জার্মানিতে ওপেন পিট মাইনিং সম্ভব হলেও বাংলাদেশে ঘনবসতির জন্য তা সম্ভব নয়, তাই সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবে না (ডেইলি স্টার, ২৮.০৬.২০১০)। এরপর ওপেন পিট মাইনিংয়ের বিষয়টি কিছুটা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু জ্বালানিবিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি দল জার্মানির Hambach Cologne-এর উন্মুক্ত কয়লাখনি পরিদর্শন করেন। তাঁরা ফিরে এসে বলেন, হামবাক কলোনের মাটি, কয়লার ধরন ও ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়ার মিল আছে, তাই এখানেও ওপেন পিট করা যাবে। তার পর থেকেই বড়পুকুরিয়ায় জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় (ডেইলি স্টার, ০৬.০২.২০১১)। তবে বাস্তব পরিস্থিতি অবশ্যই এক রকম নয়।
উল্লেখ্য, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনির গভীরতা ১০০ মিটারের বেশি হলে তা লাভজনক হয় না। জার্মানির হামবাক এলাকায় লিগনাইট জাতের কয়লা ১০০ মিটার গভীর থেকে ঢাল হয়ে ৫০০ মিটার গভীর পর্যন্ত জমা আছে। সেখানে তাই ১০০ মিটার উন্মুক্ত সুড়ঙ্গ করে দূরবর্তী এলাকার লিগনাইট কয়লা তোলা হচ্ছে। বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীর বিটুমিনাস কয়লার স্তর ১৫০ মিটার থেকে ৪৫০ মিটার গভীরে নৌকার আকারে অবস্থিত বিধায় উন্মুক্ত পদ্ধতি লাভজনক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীর কয়লা স্তরের ওপরের ১৫০ মিটার ধুপি টিলা পানির স্তর আছে, যার চাপ এত বেশি যে পাম্পে ক্রমাগত পানি তুলে বা অন্যভাবে ঠেকিয়ে রাখা মোটেই সম্ভব নয় বিধায় ব্রিটিশ কনসালট্যান্ট Wardell Armstrong মে ১৯৯১ কুয়া ও সুড়ঙ্গ পদ্ধতির সুপারিশ করে। হামবাক কলোন এলাকায় পানির চাপ খুবই কম, যা ক্রমাগত পানি তুলে সামাল দেওয়া গেছে। সংসদীয় কমিটির সদস্যরা সমীক্ষার প্রতি তোয়াক্কা না করে কাদের উদ্যোগে জার্মানির ওই কয়লাখনি পরিদর্শন করেছিলেন, তার তথ্য পেলে তাঁদের সুপারিশের গূঢ় কারণ স্পষ্ট হতে পারে।
আমরা সরকারি বা বেসরকারি প্রকল্পে জমি হুকুমদখলের প্রক্রিয়া শুরু করার আগে পর্যায়ক্রমে চার ধরনের সমীক্ষা করার কথা বলি। এসব হচ্ছে:
১. অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা: প্রকল্পটির ধারণাপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব বিষয় বিবেচনা ও যাচাই করে এই সম্ভাব্যতা প্রস্তুত করতে হবে—(ক) বাজার ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে বিদ্যমান চাহিদা, (খ) প্রকল্পের জন্য নির্মাণ উপকরণ, মিষ্টি পানি ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎস, (গ) প্রকল্প দ্বারা উৎপাদন সম্ভাব্যতা এবং পণ্যের বাজার চাহিদা, (ঘ) প্রকল্প নির্মাণ বাবদ ব্যয় ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি, (ঙ) প্রকল্প নির্মাণ বাবদ নবায়নযোগ্য কৃষি ও বনসম্পদের ক্ষতি, (চ) প্রকল্প নির্মাণ অর্থের উৎস, চুক্তির যৌক্তিকতা ও ফিরতি আয়, (ছ) প্রকল্প পরিচালন, সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। এর ফলে স্থানীয়ভাবে কিছু ক্ষতি হলেও জাতীয় ভিত্তিতে প্রকল্পটির অর্থনৈতিক লাভক্ষতি বেরিয়ে আসবে।
২. কারিগরি সম্ভাব্যতা: প্রকল্পটির অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব বিষয় বিবেচনা ও যাচাই করে এই সম্ভাব্যতা প্রস্তুত করতে হবে—(ক) ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং বিদ্যমান ভৌত কাঠামোর ভিত্তিতে স্থান নির্বাচন, (খ) নির্মাণ প্রযুক্তি, দক্ষ লোকবল, নির্মাণ উপকরণ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, (গ) প্রকল্প ও পুনর্বাসন নকশা প্রণয়ন, তদারকি ও জবাবদিহি, (ঘ) প্রকল্প পরিচালনায় নবায়নযোগ্য কাঁচামালের নির্ভরতা, (ঙ) প্রকল্পের জীবনকাল, জনগণের সম্পৃক্ততা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা। এই সমীক্ষার ফলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন পদ্ধতির সম্ভাব্য দিকগুলো বেরিয়ে আসবে।
৩. সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা: প্রকল্পটির স্থান নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব বিষয় বিবেচনা ও যাচাই করে এই সমীক্ষা প্রস্তুত করতে হবে—(ক) বিদ্যমান অবস্থায় স্থানীয় জনগণের জীবিকা ও প্রস্তাবিত জীবিকা, (খ) বিদ্যমান ঐতিহ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর অভিঘাত ও প্রস্তাবনা, (গ) স্থানীয় জনগণের আবাসন এবং প্রস্তাবিত বিকল্প আবাসনব্যবস্থা, (ঘ) বিদ্যমান অবস্থায় নারীর কর্মসংস্থান এবং প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান, (ঙ) শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ, শিক্ষা ও বিনোদনের বিকল্প ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে প্রকল্পটি স্থানীয় জনগণের জীবনধারণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে কি না এবং না হলে কীভাবে তা করা যাবে, জনগণের বিকল্প জীবিকা কী হবে, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কী কী ব্যবস্থা হবে, তার সুপারিশ থাকবে।
৪. পরিবেশগত অভিঘাত: প্রকল্পটির স্থান নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব বিষয় বিবেচনা ও যাচাই করে এই সমীক্ষা প্রস্তুত করতে হবে—(ক) প্রকল্পের জন্য পশু, পাখি, মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও ভূমিজ গাছপালার ক্ষতি, (খ) প্রকল্পের কারণে চারপাশের জনজীবন ও পরিবেশের ওপর অভিঘাত, (গ) প্রকল্পের কারণে সাংবার্ষিক জলবায়ুর পরিক্রমণের ওপর অভিঘাত, (ঘ) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশগত আইনে প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা, (ঙ) প্রকল্পের জন্য উত্তোলিত জল ব্যবহার এবং বর্জ্য শোধনব্যবস্থা ইত্যাদি। এই সমীক্ষার ফলে প্রকল্পটি পরিবেশবিমুখ হবে না।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ওপর জনগণের মালিকানা ১০০ শতাংশ হলে তা উত্তোলন অবশ্যই যুক্তিসংগত হবে। তবে পর্যায়ক্রমে সমীক্ষা চালালে প্রকল্পটি প্রকৃতই দেশের জন্য লাভজনক কি না, তা পরিষ্কার হবে। বর্ণনা অনুযায়ী প্রতিটি ধাপের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করে তা দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করলে কারও মনে কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক। সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
Email: minamul@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.