আলোচনা- শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না by মহসীন হাবিব

'এ দেশের অধিকাংশ স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্র অভিনেতা আয়কর দেন না! আমি এ বছর ১০ লাখ টাকা আয়কর দিয়েছি, কিন্তু অনেকেই আছেন যাঁরা কোটি কোটি টাকা আয় করেও আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন... ...।' ১১ ডিসেম্বর এ কথাগুলো একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলে যাচ্ছিলেন সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর। এখন তিনি 'গান-বাজনা' প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। কেন ছেড়েছেন, তা নিয়েও কিছু আক্ষেপ করেছেন।
তিনি এখন বিএনপির কর্মী হিসেবে রাজনীতি করছেন। ভবিষ্যতে হয়তো 'এমপি পেশা' গ্রহণ করবেন। কিন্তু টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তাঁর বলা অনেক কথা আলোচনার দাবি রাখে। অন্তত নিবন্ধকারকে আসিফের বক্তব্য ভাবিয়েছে অনেক রকম করে।
১০ তারিখে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে জাঁকজমকপূর্ণ 'কিং খান লাইভ ইন ঢাকা' অনুষ্ঠানে দর্শক মাতিয়েছেন বলিউডের জনপ্রিয় নায়ক শাহরুখ খান। আসিফ শাহরুখ খানকে নিয়ে মাতামাতি, হিন্দি আকাশ-সংস্কৃতির বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সেই সঙ্গে দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন দেশীয় সংস্কৃতি উপভোগ ও চর্চা করতে।
আয়কর বিষয়ে আসিফের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট এবং ন্যায়সংগত। তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ না করে উপায় নেই। সাংস্কৃতিক কর্মীরা সমাজের বিবেক। তাঁরা যদি প্রকৃত আয় গোপন করে আয়কর ফাঁকি দেন, এর চেয়ে সংকীর্ণতা আর কী হতে পারে? আয়কর নিয়ে বাংলাদেশে চলছে নানা ধরনের ফাঁকিবাজির খেলা। তবে এখন পর্যন্ত আয়কর বিষয়ে সবচেয়ে বড় সত্য হলো, দেশে মানুষের মধ্যে আয়কর প্রদানের অভ্যস্ততা গড়ে ওঠেনি। আয়কর বিভাগের নানা অনিয়মের কারণে আয়কর প্রদানে দেশের অনেক মানুষ শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠছেন না।
তবে শাহরুখ খানকে নিয়ে 'মাতামাতি' বিষয়ে আসিফ যে আক্ষেপ করেছেন, তা ঘিরে অনেক কথা চলে আসে। বাংলাদেশে কেন, শাহরুখের মতো অভিনেতার অনুষ্ঠান উপভোগ করাটা স্বাভাবিক আনন্দের খোরাক না হয়ে মাতামাতি পর্যায়ে চলে যায়? কেন এ দেশে এতটা জনপ্রিয় কোনো চরিত্র গড়ে ওঠে না? এর পেছনে অনেক কারণ। প্রথমত, এ দেশের ঘরে ঘরে বিনোদনের বড় মাধ্যম হিন্দি সিনেমা, হিন্দি মেলোডিয়াস গান। হিন্দি চ্যানেলগুলোর প্রাদুর্ভাবে ঘরে টেকা দায়। এ জন্য এককথায় 'সাংস্কৃতিক আগ্রাসন' বলে অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই। মানুষের বিনোদন ও সৃজনশীলতা কোনো ভূগোল মানে না, গোষ্ঠী বা ভাষা মানে না, সম্প্রদায় মানে না। যার মধ্যে মানুষ আনন্দ পায়, উপভোগ্য মনে হয়, তা থেকে কোনো ব্যাকরণ দিয়ে ফিরিয়ে রাখা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন নিজেদের সংস্কৃতিচর্চাকে উপভোগ্য ও সৃজনশীলতা দিয়ে প্রস্ফুটিত করা। তাহলেই মানুষের মধ্যে দেশীয় সংস্কৃতির ওপর দরদ তৈরি হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ দেশে সব শ্রেণীর মানুষ বাউলসংগীতের প্রতি ভয়ানক দুর্বলতা বোধ করে। ভারতে অসংখ্য বাউলশিল্পী রয়েছেন। কই, এ দেশের মানুষ তো ভারতের কোনো বাউলশিল্পীকে নিয়ে মাতামাতি করে না! বারী সিদ্দিকী, চন্দনা মজুমদার, কিরণ চন্দ্র রায়সহ অসংখ্য প্রতিভাবান শিল্পী মানুষের বাউল দর্শনের ক্ষুধা মিটিয়ে দিচ্ছেন। ভারতের এখানে জায়গা কোথায়? রবীন্দ্রসংগীতে কিছুটা হলেও পশ্চিম বাংলানির্ভরতা কমে এসেছে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, লাইসা আহমেদ বা অদিতি মহসীনের মতো গুণী শিল্পীদের উদয়ের কারণে। শুধু তাই নয়, এ শিল্পীরা সদম্ভে বিস্তৃত হয়েছেন সীমান্তের ওপারে।
কিন্তু আধুনিক গান, প্রেমের গান, চলচ্চিত্রের গানের ক্ষুধা দেশের মানুষের মেটে না। আর চলচ্চিত্রের তো কথাই নেই। কোনো মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের ঘরে ঢাকাই সিনেমা দেখা তো দূরের কথা, ওগুলো অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। পরিচালকরা যদি ছবি তৈরির আগেই মাথায় রাখেন রিকশাচালকরা ছবিটি 'খাবেন' কি না, তাহলে সে ছবি নিয়ে মাতামাতির সুযোগ কোথায়? গুলশান-বনানী-ধানমণ্ডির ছেলেমেয়েরা তা উপভোগ করবেন কেন? ইন্টারনেট তথা প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মানের সৃজনশীলতার দিকে মানুষের নজর থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষুধা দেশের ভেতর থেকেই মানুষ প্রথম মেটাতে চেষ্টা করে, না পেয়ে অন্য সংস্কৃতির দ্বারস্থ হয়।
দর্শকরা কেন শাহরুখ খানকে নিয়ে মাতামাতি করলেন_সে দোষ দিয়ে লাভ আছে? দেশে কি শিল্প-সংগীত-সাহিত্যের প্রতি কোনো প্রতিশ্রুতি (কমিটমেন্ট) গড়ে উঠেছে? একমাত্র প্রতিশ্রুতি আছে বাউল সমাজে। তাই প্রায় অর্ধ পেটে থেকে সদম্ভে দেশের মাটি চষে বেড়াচ্ছেন বাউলরা। মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা কুড়িয়ে নিচ্ছেন। দেশে অসংখ্য আধুনিক, রবীন্দ্র, নজরুলসংগীতের সম্ভাবনাময় শিল্পী ছিলেন। সেসব শিল্পীকে আমরা কী রকম দেখছি? ৩০-৪০ বছর আগে একজন শিল্পী যে গান দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন_সেই গানটিই এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে শোনাচ্ছেন। তার ওপর আবার গলাটি নানা ধরনের অত্যাচারে নষ্ট করে ফেলেছেন। সবে সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছেন_এমন শিল্পীরা সুযোগ পেলেই আমেরিকায় গিয়ে দোকানদারি করছেন আর সুন্দর রাস্তাঘাট-ভবন দেখে নিজেকে পরিতৃপ্ত করছেন। নামোল্লেখ করা ঠিক হবে না, কিন্তু দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয়, জনপ্রিয় গায়ক-গায়িকা এখন আমেরিকায় থাকেন। এ দেশের মানুষের ভালোবাসা-প্রতিষ্ঠা ছেড়ে অতি সংকীর্ণ মনে ইন্দ্রিয়সুখকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাহলে দেশের মানুষ বর্তমান শিল্প-সাহিত্যের কাছে কী আশা করতে পারে?
শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না, হতে পারে না। একটি সমাজে উপভোগ্য সংগীতের পেছনে থাকে শাস্ত্রীয় সংগীতের শক্ত ভিত্তি। নওশাদ থেকে শুরু করে এ আর রহমান পর্যন্ত অঢেল কম্পোজার ভারতে এমনিতেই সৃষ্টি হননি। সহজাত প্রতিভার সঙ্গে থাকতে হয় সাধনা ও শিক্ষা। আজ দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র এবং সংগীত গোটা ভারতে দাপটের সঙ্গে ডোমিনেট করছে। এর পেছনে আছে দক্ষিণ ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতের অবদান। আমাদের দেশে পণ্ডিত রামকানাই সেন দাশের মতো প্রতিভাবান সংগীত ব্যক্তিত্বকে টেলিভিশনের 'রাতের ঢাকা' অনুষ্ঠানে দয়া করে এনে দেখানো হয় (এটি প্রচারমাধ্যমের দরিদ্রতাও বটে)। এ সমাজ কোথায় পাবে গুণী শিল্পী? দেশে এখন শিল্পী তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে সাবান কম্পানি, স্নো-পাউডার কম্পানি। রাস্তা থেকে সাধারণ মানুষ ধরে এনে তারা শিল্পী বানায়। একজন ঈশা কোপিকার আমরা কোথায় পাব?
দ্বিতীয়ত, ভারতের সিনেমা এবং গানের শিল্পীদের বাংলাদেশে সচরাচর যাতায়াত নেই। তাঁরা এখানে দুষ্প্রাপ্য বস্তু। কারণ ভারতীয় শিল্পী ও কলাকুশলীরা এত বড় একটি বাজারকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখে থাকে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সুযোগ হয়, কিন্তু একজন অমিতাভ বচ্চনের সারা জীবনে একবার বাংলাদেশে সফরের সুযোগ বা আগ্রহ হয় না। প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পীদের এখানে অনুষ্ঠান করার জন্য আনতে মাথার ঘাম পায়ে পড়ে যায়। এর কারণ মোটেই অর্থনৈতিক নয়। ভারতের অনেক রাজ্যের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী। এ দুষ্প্রাপ্যতার কারণ, বাংলাদেশের শিল্পী, কলাকুশলীদের মানসম্মত যোগাযোগ নেই। অর্ধেক অনুপ জালোটা থাকলে একখানা অনুপ জালোটাকে সহজে নিয়ে আসা যায়। একেবারে না থাকলে টাকার বিড করে কতক্ষণ?
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলতে একটি কথা প্রায়ই বড় বড় মানুষের মুখে শুনে থাকি। এটি একটি খেলো বাক্য। এর কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। একটি সুশিক্ষিত, সৃজনশীল, সংস্কৃতিবান জাতিকে অস্ত্রের মুখে দখল করে নেওয়া যায়, তার শক্তিশালী সংস্কৃতিকে দখল করা যায় না। উপমহাদেশ ২০০ বছর শাসন করে ইংরেজরা জোর করে তাদের সংগীত, নাটক, সাহিত্য দিয়ে এখানকার সংস্কৃতিকে বিতাড়িত করতে পারেনি। ইংরেজদের শক্তিশালী সংস্কৃতির যতটা উপমহাদেশ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে, ঠিক ততটাই এখানে সমাদৃত। সুতরাং শাহরুখ খানের উষ্ণ অনুষ্ঠানকে মাতামাতি বলে কলুষিত করতে চেষ্টা করা অন্ধ রক্ষণশীলতারই নামান্তর।
============================
ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মহসীন হাবিব
সাংবাদিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.