ভ্রমণ- ট্রেন টু বেনাপোল by ফখরে আলম

সূর্য সবে জেগে উঠেছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কুয়াশা তাড়াবে। খুলনা রেলস্টেশনে ব্যস্ততা বেশি নেই। চা-বিস্কুট খেয়ে ৩০ টাকার টিকিট কেটে আমি আর আলোকচিত্রী ফিরোজ গাজী বেনাপোলগামী ট্রেনে চেপে বসি। অনেক লম্বা বগি। বেশ কিছু সিট খালি। ট্রেনের আড়মোড়া ভাঙল সকাল ৭টা ২০ মিনিটে। ভেঁপু বাজল, ট্রেন চলল। বড়ই শম্বুকগতি তার। সুবিধভই হলো_দেখা যাবে মন দিয়ে। বি এল কলেজ চলে এল কিছু সময় পর।
হালকা সোনা আলো কলেজের পুরনো ভবনগুলোর গায়ে এসে পড়েছে। বি এল কলেজ রেখে ট্রেনলাইনের ডান পাশে দৌলতপুর রেলস্টেশন। ট্রেন থামলে উঁকি দিয়ে বাঁ দিকে দৌলতপুর বাজার দেখি। দৌলতপুর একসময় পাটের জমজমাট বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। রেললাইনের পাশেই এক মহিলা গরম রুটি সেঁকছেন। ফুলোফুলো রুটি দেখে লোভ হলো; কিন্তু সময় যে নেই। আমার পাশের আসনে দুই তরুণ_সোহাগ ও অংশু দত্ত। বাড়ি তাঁদের বাগেরহাট। তাঁরা ছাত্র। ভারত যাচ্ছেন। প্রথম ভারত যাওয়ার আনন্দ চোখে-মুখে। ফুলবাড়ী গেট রেলক্রসিং। অনেক লোক এখানে। মৃতপ্রায় পাটকলে শ্রমিকরা কাজ করতে যাচ্ছেন। খুলনামুখী কয়েকটি বাস ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে। রেল চললে বিস্তীর্ণ খালি প্রান্তর দেখি। ধান কাটা হয়ে গেছে, এবার সরিষা নয়তো আলু বুনবে। বিল ডাকাতিয়ার পাশ দিয়ে ট্রেন ছুটছে। ডাকাতিয়ার পানি যে কই গেছে? ছোট একটি ব্রিজ পার হয়ে ট্রেন যশোরের সীমানায় ঢুকে পড়ে। রেললাইন ঘেঁষে লম্বা দেয়াল। নওয়াপাড়া আকিজ জুট মিল। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ পাটকল। মনে হয়, ট্রেনের সঙ্গে পাটকলের সীমানাপ্রাচীরও ছুটছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে নওয়াপাড়া রেলস্টেশনে এসে ট্রেন থামে। এই স্টেশনটি গুরুত্বপূর্ণ। লাইন আছে কয়েকটি, নতুন ভবনও হয়েছে। ভেঁপু বাজিয়ে ট্রেন ছুটছে। বাঁয়ে ভৈরব। জানালা দিয়ে দেখি, ভৈরব ঘাটে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি বার্জ। বার্জ থেকে সার আর সিমেন্ট নামাতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। এক মিনিটে এ দৃশ্য গায়েব হয়ে যায়। রেললাইনের দুই পাশে নানা গাছ। কয়েকটি ঢ্যাঙা তালগাছও চোখে পড়ে। ট্রেনের গতি কমে যায়। সিঙ্গিয়া স্টেশন। স্টেশন ছোট, দোকানপাটও নেই। লাইনম্যান সবুজ পতাকা নিয়ে ছুটে আসেন। ট্রেন ছুটতে থাকে। কয়েকটি নতুন শিল্প-কারখানা রেখে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। জানালা দিয়ে সিঙ্গিয়ার বিরাট দিঘিটি দেখতে পেলাম। শান বাঁধানো ঘাটটিও দেখি। ট্রেন যশোর রেলস্টেশনে ঢুকছে। দূর থেকে চোখে পড়ে, প্লাটফর্মের গায়ে লেখা_'যশোহর জংশন'। বিরাট স্টেশন। অর্ধেক নতুন আর অর্ধেক সেই ব্রিটিশ আমলের। স্টেশনের মাঝ বরাবর সংবাদপত্রের স্টল। ছুটে গিয়ে কাগজ কিনি। চা পান করি। আবার ভেঁপু বেজে ওঠে। একটু পরই দুজনার দুটি পথের মতো বেনাপোল-ঈশ্বরদী দুটি রেলপথ দুই দিকে চলে গেছে। ১৮৮৪ সালে বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে নামের একটি প্রাইভেট কম্পানি ব্রিটিশ ভারতে কলকাতা থেকে বেনাপোল হয়ে যশোর পর্যন্ত এই রেললাইনটি নির্মাণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে এটি খুলনা পর্যন্ত সম্প্র্রসারিত করা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কলকাতার শিয়ালদহ থেকে খুলনা পর্যন্ত নিয়মিত যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করেছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ওই পথে রেল চলাচল শুরু হয়, ১৯৭৪ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৯ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ফের খুলনা-বেনাপোল যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আগে দিনে দুটি ট্রেন চললেও এখন প্রতিদিন একটি করে ট্রেন চলছে। ২০ মিনিটের মধ্যে ট্রেন পেঁৗছে যায় ঝিকরগাছা স্টেশনে। এটিও ব্রিটিশের সময় নির্মিত পুরনো স্টেশন। নস্টালজিয়া হাত ধরে টানে। দুই মিনিট যাত্রাবিরতির পর ট্রেন ছোটে। এক মিনিট পরই মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই কপোতাক্ষ নদ। নদের বুকে চেপে বসে আছে কচুরিপানা। কপোতাক্ষ নদের লাল লোহার ব্রিজ ডিঙিয়ে ট্রেন ছুটতে থাকে। একাত্তরে হানাদাররা এই ব্রিজটিও ধ্বংস করে ঝিকরগাছা থেকে যশোরে পালিয়েছিল। রেললাইনের পাশের মেঠোপথ দিয়ে ছেলেমেয়েরা বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। দুটি উদোম শিশু রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তেই থাকে। রেললাইনের দুই ধারেই বস্তি। বস্তিতে টিনের চালও রয়েছে। রোদ্দুরে সেই চাল চিকমিক করছে। চালে শোভা পাচ্ছে বড় বড় চালকুমড়া ও মিষ্টিকুমড়া।
হঠাৎ শুনি, 'মাজায় ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা, গিরায় গিরায় ব্যথা...। হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। বড় বড় চিকিৎসক দেখিয়েছেন_ব্যথা সারেনি। মানুষ বেইমানি করে; কিন্তু আমার এই গাছ বেইমানি করে না। সব ব্যথা নাশ করে। এর জন্য টাকা লাগবে না। খুশি হয়ে যা দেবেন তা-ই সই।' লেকচার শেষ হওয়ার আগেই এক অন্ধ ফকির গেয়ে ওঠে, 'সব ব্যথা সেরে যাবে মরণের পরে।' ব্যথানাশক গাছ বিক্রেতা আর ওই ভিক্ষুকের মধ্যে শুরু হয় বচসা। দুজনই চুপ। এরপর রেললাইনের দুই ধারে বিস্তীর্ণ পেঁপের বাগান। বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটি গোলাপ, রজনীগন্ধার বাগানও চোখে পড়ে। ২০ মিনিট পর ট্রেন নাভারন স্টেশনে থামে। এ স্টেশনটিও পুরনো। ২ মিনিটের যাত্রাবিরতির পর শেষ গন্তব্যস্থল বেনাপোল সীমান্তের দিকে ট্রেন ছুটতে থাকে। হঠাৎই ট্রেনের শব্দে একদল রাজহাঁস ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে। এ দৃশ্য দেখে গরুর দুরন্ত বাছুর দে-ছুট। মায়ের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট সময় নিয়ে ৯২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গ্রাম্য জনপদের এমন দৃশ্য উপভোগ করিয়ে সকাল ১০টায় বেনাপোলে গিয়ে ট্রেনটি থামে। কিন্তু লাইনটিকে যেতে হবে ভারতে।
==========================
বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ফখরে আলম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.