মুক্তিযুদ্ধ- মুক্তির মন্দির সোপান তলে by জাহীদ রেজা নূর

৪ ডিসেম্বর। তারিখটি শোকের। ১৯৭১ সালের এই তারিখটির কথা মনে এলেই চোখে ভেসে ওঠে কাদামাখা একটি মাইক্রোবাস। ভারী বুটের শব্দ। মাফলারে আড়াল করা চেহারা। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। হ্যাঁ, সেদিন এভাবেই হানাদার বাহিনী ও আলবদরের সদস্যরা দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যায়।
সারা দেশ যখন বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত, ১৬ ডিসেম্বর যখন জানিয়ে দিল বাংলা নামের দেশটি এখন বিশ্বমানচিত্রের অংশ, তখনই জনে জনে রটে যায় রায়েরবাজারের কথা, কাটাসুরের কথা। বিজয় দিবসের বাঁধভাঙা আনন্দের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার শোকগাথা। প্রকাশ হতে থাকে বুদ্ধিজীবী হত্যার কাহিনি। জানা হয়ে যায়, ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
ডিসেম্বরের এই হত্যাকাণ্ডের শিকার যাঁরা হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও অধ্যাপক আনোয়ার পাশা; ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. আবুল খায়ের ও গিয়াস উদ্দীন আহমেদ; ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রাশীদুল হাসান; আইইআর বা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের ড. সিরাজুল হক খান, ড. এম এ এম ফায়জুল মহী ও ড. শাহাদত আলী; গণিত বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। সাংবাদিকদের মধ্য ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নাজমুল হক ও সেলিনা পারভীন। চিকিৎসকদের মধ্যে ছিলেন ডা. ফজলে রাব্বী ও ডা. আলীম চৌধুরী প্রমুখ।
একাত্তরের সাংস্কৃতিক রাজাকাররা তৈরি করেছিল বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। সেই তালিকা তারা তুলে দিয়েছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর হাতে। তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে দেশের সেরা মেধাবীদের ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা; নিয়ে যায় মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে তারা তৈরি করেছিল টর্চার সেল বা নির্যাতনকক্ষ। পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।
বিশ শতকের গোড়ায় আর্মেনিয়ায় গণহত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যা, চীনের নানকিং গণহত্যা, রুয়ান্ডার গণহত্যা, কম্বোডিয়ার গণহত্যা, সার্বিয়ার গণহত্যার কথা আমরা জানি। আমরা আমাদের দেশে সংঘটিত গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকে কীভাবে দেখি? কারা এ কাজটি করেছিল? শুধু পাকিস্তানিরা?
না। আগেই বলা হয়েছে, এ দেশের রাজাকার-আলবদররাই তৈরি করেছিল তালিকা। ১৯৭১ সালের ৯ বা ১০ ডিসেম্বর পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে রাও ফরমান আলী, জেনারেল নিয়াজি ও ১৪ ব্যাটালিয়নের প্রধান জেনারেল জামশেদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নিয়ে আলোচনায় বসেছিল। সেই আলোচনার ফল কী হয়েছিল, সেটা বাংলাদেশ দেখেছে ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কেউই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার দায় নিজের কাঁধে নিতে চায় না। কিন্তু ইতিহাস আমাদের সামনে ভুল পাতা খুলে দিচ্ছে না। ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে এই নির্লজ্জ, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ। ডিসেম্বরের শুরুতেই পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে, এ দেশকে দখলে রাখা আর সম্ভব নয়। পাকিস্তানি জেনারেলরা প্রাণ বাঁচাতে অস্ত্রবিরতির জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠে। ৭ ডিসেম্বর গভর্নর এ এম মালিক ও সেনাপ্রধান নিয়াজির তরফে হেডকোয়ার্টার্সে বার্তা পাঠানো শুরু হয় লড়াই বন্ধ করার মিনতি জানিয়ে। মিত্র বাহিনী ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ঢাকার উপকণ্ঠে। পাকিস্তানি জেনারেলরা তখন আত্মসমর্পণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। শর্ত কেবল তাদের নিরাপদে দেশে ফিরতে দিতে হবে। কিন্তু তারা একই সঙ্গে চালায় বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা। পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নীলসংকেত পেয়ে আলবদর সদস্যরা নেমে পড়ে মাঠে। রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে দেশের মেধাবী মানুষকে। জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল রাও ফরমান আলী লিখেছেন তাঁদের স্মৃতিকথা। কিন্তু তাঁরা বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের সঙ্গে তাঁদের জড়িত থাকার কথা বেমালুম চেপে গেছেন। কিন্তু হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এ দুই জেনারেল। একটু আগেই বলা হয়েছে এ বিষয়ে তাঁদের বৈঠকের কথা।
শহীদ পরিবারগুলো এই ৩৯ বছর নীরবে অশ্রু ফেলেছে।
এখন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ কখনো তামাদি হয় না, তাই আমরা আশা করতে পারি, একাত্তরে যারা বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের বিচার হবে।
একটি পাপমুক্ত, কলঙ্কমুক্ত ভবিষ্যৎ চায় তরুণ প্রজন্ম। অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করে তরুণদের সেই কলুষমুক্ত সমাজ উপহার দেওয়া যেতেই পারে।
=========================
আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ জাহীদ রেজা নূর


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.