মুক্তিযুদ্ধ- স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে by নুসরাত রাব্বী

‘আব্বা, আমি বড় হয়ে কী হব?’ পূর্ণ বিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ছয় বছর বয়সী কন্যার প্রতি সমান বিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে আব্বা বলেছিলেন, ‘মা, তুমি পরমাণুবিজ্ঞানী হবে।’ আমার আব্বা শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. মো. ফজলে রাব্বী। তিনিই একমাত্র বাঙালি বাবা নন, যিনি তাঁর মেয়ের সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তিনি এক অসাধারণ বিজ্ঞানী—পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক—যিনি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দমননীতি থেকে তাঁর জাতির মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন।
আমার এখনো মনে পড়ে, একাত্তরের সেই ভয়াল দিনগুলোতে তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের কত আবেগ নিয়ে বলতেন। ১৯৪৭ সালের বিভক্তির পর আমরা পূর্ব পাকিস্তানি হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। শিগগিরই আমরা বুঝতে পারি যে শুধু মুসলিম পরিচয়ই নয়, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের রয়েছে সমান অঙ্গীকার। ধর্মের প্রতি আমাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি এই ঐতিহ্য থেকেই প্রাপ্ত এবং এ জন্যই আমরা বহু ধর্মবিশিষ্ট অনেকগুলো গোত্র শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলে একসঙ্গে বসবাস করতে পারছি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মিছিলে গুলি করে পাকিস্তানি পুলিশ বেশ কয়েকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে হত্যা করে। সেই ছাত্ররা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির চিত্রটি ছিল খুব বিবর্ণ। সোনালি আঁশ পাট ও বস্ত্র খাত অনেক বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে এলেও পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পূর্বাংশ সৎ ভাই বলে গণ্য হতো। সেই সময় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার পরিব্যাপ্ত অনুভূতি পূর্ব পাকিস্তানে গভীর অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল।
ষাট ও সত্তরের দশকে আমার বেড়ে ওঠার সময়ে জেনেছি, সাধারণ মানুষের জীবনকে নতুনভাবে গড়ার জন্য তাদের চাহিদাগুলো কত সরল—খাদ্য, বসতি, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক মানবাধিকারের ব্যবস্থা করা, আমাদের আত্মিক, রাজনৈতিক ও ভাষিক স্বাধীনতার ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বজায় রাখা এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যেখানে সবার শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সর্বোচ্চ জাতীয় অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু তৎকালীন শাসকেরা এসব বিষয় সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন।
আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বস্ত্র ও পোশাক খাতে সাফল্য, পাটশিল্পের পুনর্জাগরণ কিংবা দ্রুত বর্ধনশীল টেলিযোগাযোগ খাত—বিশ্ব অর্থনীতির টেকসই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন অনেক সক্রিয়। ১৯৭১ সালে যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশ যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটি কার্যকর অর্থনীতি অর্জন করেছে, তা এক বড় সাফল্য।
প্রকৃতপক্ষে দেশকে অন্ধকার থেকে বের করে নতুন শতাব্দীর আলোয় নিয়ে এসেছে এ দেশের সাধারণ মানুষই। বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীর বিপরীতে সাধারণ মানুষ তাদের সাহস, বিশ্বাস ও বিচক্ষণতা দিয়ে নিজেদের অসাধারণ প্রমাণ করেছে। শিক্ষক সমিতি, আইনজীবী সংঘ, এনজিও, সাংবাদিক ও অন্যান্য সংস্থা মিলে দেশকে পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিতে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা ও ক্ষমতায়নের সম্মিলন ঘটানোর মাধ্যমে বিশ্বে এ দেশের একটি অনন্য পরিচয় দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক এবং পরিবেশবিষয়ক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন সমাধান হিসেবে ক্ষুদ্র অর্থায়ন ও ক্ষুদ্রঋণ বিশ্বে বিপ্লবের সৃষ্টি করেছে।
নারী ও শিশু অধিকার রক্ষা একটি দেশের জন্য মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ড. রাব্বী নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তাঁর স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আমার আম্মা ড. জাহানারা রাব্বীর সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হয়, আমার বাবা তাঁকে মেডিকেল কলেজের সহপাঠী হিসেবেও পূর্ণ শ্রদ্ধা করতেন। আমার মা নারী শক্তিতে বলীয়ান একটি পরিবার থেকে এসেছিলেন। ১৯৭১ সালে তাঁর স্বামীকে হারানোর পর মিসেস রাব্বী একলা হাতে আমাদের সবাইকে গড়ে তুলেছেন। তাঁর শক্তি ও প্রেরণাই আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে এবং আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োস্ট্যাটিসটিকসে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করতে পেরেছি।
১৯৭১ সালে অনেক পরিবারই বাবাকে হারিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। আমার মায়ের মতো যুদ্ধে স্বামীহারা নারী জীবনব্যাপী যে অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁর প্রতি আমি সব সময় কৃতজ্ঞ। যুদ্ধে সঙ্গীহারা অসংখ্য নারী ও বিপত্নীক এখনো রয়েছেন, যাঁরা স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পেনশন সেবা থেকে বঞ্চিত এবং দারিদ্র্যের মাঝে বসবাস করছেন। অনেক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত মানুষ রয়েছেন, যাঁরা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জীবন যাপন করছেন। এভাবে বেঁচে থাকা মানুষের পুনর্বাসন করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা আমাদের দায়িত্ব। এই বিজয় দিবস উৎসব উদ্যাপনের প্রাক্কালে এটি আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।
=========================
আমাদের আকাশ থেকে নক্ষত্র কেড়ে নিয়েছিল যারা...  মুক্তির মন্দির সোপান তলে  আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. নুসরাত রাব্বী
শহীদ বুদ্ধিজীবী ফজলে রাব্বীর মেয়ে।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.