আন্তর্জাতিক- ভারতে বিহার রাজ্যের নির্বাচন by ফারুক চৌধুরী

কসময় বিহারের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি সাধারণ কথা প্রচলিত ছিল, তা হলো, ‘যব তগ রহেগা সামোসা মে আলু। তব তগ রহেগা বিহার মে লালু।’ লালু হলেন ভারতের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, লালু প্রসাদ যাদব। তিনি বহু বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিহার রাজ্যে প্রবল প্রতাপশালী ক্ষমতাধর ছিলেন। এখন অবস্থা হলো এই যে বহুলাংশে নিরামিষাশী বিহারিরা তাদের সামোসায় আগের মতোই আলু খাচ্ছেন,
কিন্তু বিহার নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে লালু প্রসাদ যাদব আর তাঁর সহক্ষমতাধারী সহধর্মিণী রাবড়ি দেবী অপস্রিয়মাণ স্মৃতি। তার কারণ হলো দুর্নীতি, নির্বাচনী অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থতা, গলাবাজি আর ধাপ্পাবাজি। বিহারের ভোটদাতারা ২০০৫ ও ২০১০ সালের অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে দুই কিস্তিতে প্রমাণ করেছেন যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি, মিষ্টি কথা আর নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যায় না। ২০০৫ সালে লালুর রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) ক্ষমতা হারাল আর ২০১০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে তাঁরা এই দুজনকেই আসন-হারা করলেন। বিহারের ভোটদাতারা জানিয়ে দিলেন যে মুখের কথার উত্তাপে আর সামোসার আলু ভাজা যাবে না।
রাজনীতিতে ভোটদাতাদের ক্ষমতাসীনবিরোধী মনোভাব (antiincumbancy Factor) বলে একটি কথা চালু আছে। ভারত গণতন্ত্রচর্চার ধারাবাহিকতায় আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সেখানে কিন্তু শুধু বিহারে নয়, ২০০৭ সাল থেকে ২০টি রাজ্য সরকারের নির্বাচনের মধ্যে ১৫টিতেই ক্ষমতাসীন সরকার পুনর্নির্বাচিত হয়েছে। অর্থাৎ ভোটদাতারা ক্ষমতাসীন সরকারের অর্জনের বিচারে তাঁদের মনস্থির করেছেন, ক্ষমতা আছে বলেই তার বিরোধিতা করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এ কথাটি কেন প্রযোজ্য হবে না? যদি ক্ষমতাসীন সরকার সরকার পরিচালনায় সফল হয়, ভোটদাতারা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। প্রশ্নটি রইবে, ক্ষমতাসীন সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার অর্জনে সফল হয়েছে কি না।
নীতিশ কুমার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে গতবারের মতোই তাঁর জনতা দল (জেডিইউ) জোট বেঁধেছিল বিজেপির সঙ্গে। বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে নীতিশ কুমার এবার অ্যাসেম্বলির ২৪৩টি আসনের মধ্যে ২০৬টিতে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর জনতা দল গত নির্বাচনে ৯১টি আসনের তুলনায় পেয়েছে ১১৫টি আসন, আর বিজেপি ৫৫টি আসনের স্থানে এবার পেয়েছে ৯১টি। অর্থাৎ গত ২০০৫ সালের নির্বাচনের তুলনায় এ দুটি দল যথাক্রমে ২৭ ও ৩৬টি আসন বেশি পেয়েছে। এদিকে লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) পেয়েছে ২০০৫ সালের পাওয়া ৫৪টি আসনের মধ্যে মাত্র ২২টি, আর তাঁর মিত্র রামবিলাস পাসোনায়ানের লোকজন শক্তি (এলজেপি) ২০০৫ সালের ১০টি আসনের তুলনায় এবার পেয়েছে মাত্র তিনটি। বিহারে শতকরা ১৭ ভাগ ভোটদাতা মুসলমান। তাঁদের অনেকেই বিজেপি-সমর্থিত জোটকে ভোট দিয়েছেন, ভোট দিয়েছেন নীতিশ কুমারকে। বিহারে রাহুল গান্ধীর নির্বাচনী প্রচারণা সত্ত্বেও কংগ্রেস পেয়েছে গতবারের নয়টি আসনের তুলনায় মাত্র চারটি। আয়তনে বিহার (৯৯ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার) ভারতের দ্বাদশ এবং জনসংখ্যায় (সাড়ে আট কোটি) ভারতের তৃতীয় রাজ্য। ভারতের ৫৪৫ আসনের লোকসভায় বিহারের রয়েছে ৪০টি আসন। অতএব রাজ্যের এই নির্বাচন আগামী জাতীয় সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে বৈকি। ভারতের রাজনীতিতে এখন একটি নতুন হাওয়া বইছে।
নীতিশ কুমার আর বিজেপি জোটের এই বিরাট সাফল্যের কারণ হলো, গত পাঁচ বছরে তারা তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার অর্জন করতে বহুলাংশে সফল হয়েছে, যা বিহারের জটিল ধর্ম আর গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতিকে উপেক্ষা করে বিহারকে নিয়ে গেছে উন্নতির পথে। গত পাঁচ বছরে বিহারের প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর গড়ে শতকরা ১১ ভাগ হয়েছে। তার কারণ, অবকাঠামো সৃষ্টিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে সরকার। ২০০৯ সালে বিহারে দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মিত হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫০০ ভারতীয় কোটি টাকা খরচে। ২০০৫ সালে সেই খাতে ব্যয় ছিল মাত্র ২৬৩ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে বিহারে ছোট-বড় ৪০০টি পুল আর কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। সেই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে হয়েছে প্রভূত উন্নতি। ২০০৪ সালে নথিভুক্ত ৪০০টি অপহরণের সংখ্যা এখন নেমে এসেছে ৬৬টিতে। বিজলি, পানি আর যাতায়াত ব্যবস্থা—সাধারণ মানুষের এই তিনটি দাবির ওপর কড়া নজর রেখেছেন নীতিশ কুমার আর নির্বাচনে ভোটদাতারা তাঁকে এর প্রতিদান দিয়েছেন। সুশাসনের মাধ্যমে উন্নয়নের রাজনীতি সমাজে যেন একটি স্বস্তির প্রভাব ফেলেছে।
মনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে যে নীতিশ কুমার তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন একটি বিশৃঙ্খল, দলভিত্তিক অপশাসিত রাজ্যে, চরম একটি অসন্তোষজনক পরিস্থিতির মাঝে। মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১১ হাজার ভারতীয় টাকা এবং ভারতের জিডিপিতে বিহারের অবদান ছিল মাত্র শতকরা ২ দশমিক ১৫ ভাগ। তাই তাঁর সাফল্যের মাত্রা বিরাট। কিন্তু মোদ্দা কথাটি হচ্ছে, নীতিশ কুমারের উন্নয়নের রাজনীতি ভারতের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন এনেছে, যা ভারতের গণতন্ত্রের পরিপক্বতা আর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক।
=========================
স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে  আমাদের আকাশ থেকে নক্ষত্র কেড়ে নিয়েছিল যারা...  মুক্তির মন্দির সোপান তলে  আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ ফারুক চৌধুরী
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.