ভারতের ‘তদবির’ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি কাঠামোয় আনা দরকার

কিছু দিন আগেও ভারতে ‘লবিং’ বা ‘তদবির’ শব্দটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ব্যবহূত হতো। সাধারণ মানুষ শব্দটি সচরাচর ব্যবহার করত না। তবে কোটি কোটি ডলারের টেলিকম কোম্পানি ২জি স্পেকট্রামের সঙ্গে ভারতের পেশাদার তদবিরকারী নীরা রাডিয়ার সম্পর্ক এবং তাঁর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টেলিফোনে আলাপের টেপ প্রকাশিত হওয়ার পর তদবিরের বিষয়টি সামনে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে তদবিরকে আইনগত বৈধতা দেওয়া হলেও ভারতে এখনো এটিকে দুর্নীতি হিসেবে দেখা হয়। তবে ভারতের প্রসারমাণ অর্থনীতি ও বিদেশি কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগে সে দেশে তদবির বিষয়টি দিন দিন ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় বিষয়টিকে ধামাচাপা না দিয়ে আইনগত কাঠামোয় আনা উচিত বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
ভারতে প্রতিদিনই বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ছে। রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পাওয়ার জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেসব কোম্পানি সাবেকি নীতি ও পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই এসব কাজ পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে করপোরেট গ্রুপগুলো এখন অর্থের বিনিময়ে লবিস্ট বা তদবিরকারী নিয়োগ করছে। এসব তদবিরকারীর কাজ হচ্ছে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে নিজ নিজ মক্কেলদের স্বার্থে কাজ বাগিয়ে আনা। কখনো পলিসি অ্যাডভোকেসি গ্রুপের আওতায়, কখনো বা ব্যক্তিগত পর্যায়ের পরামর্শক হিসেবে তদবিরকারীরা কাজ করে থাকেন।
নীরা রাডিয়া নামের যে তদবিরকারীকে নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে বিতর্ক চলছে, তাঁর ‘বৈষ্ণবী কমিউনিকেশন’ নামের যোগাযোগ ও অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভারতের টাটা ও আম্বানি শিল্প পরিবারের ব্যবসাসংক্রান্ত পরামর্শক হিসেবে তিনি কাজ করছেন।
সম্প্রতি ভারতের আয়কর কর্মকর্তারা রাডিয়ার অনেকগুলো টেলিসংলাপের টেপ প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। কাকে টেলিকমমন্ত্রী বানালে ২জি স্পেকট্রামের স্বার্থ রক্ষা হবে, তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে। রাডিয়ার ওই টেলিসংলাপে করপোরেটদের ক্ষমতার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। কৃষি অথবা অন্য কোনো জাতীয় সমস্যা নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে আজ পর্যন্ত দিন্যব্যাপী আলোচনা না হলেও আম্বানি গ্রুপের মালিকানাসংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে সেখানে দিনভর আলোচনা হয়েছে। তাঁদের কথোপকথনে বেরিয়ে এসেছে করপোরেটদের প্রভাবে রাজনীতিকেরা ওই সব কোম্পানির হয়ে কাজ করে থাকেন।
ভারতে তদবির বিষয়টিকে অনৈতিক ও দুর্নীতির সমার্থক মনে করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে সরকারিভাবে একে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর দুই হাজার পেশাদার তদবিরকারীকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত মার্কিন কংগ্রেসের ৪৩ শতাংশ সদস্য সরকারি দায়িত্ব ছেড়ে বেসরকারি তদবিরকারী হিসেবে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে এক হাজার ৯০০ নিবন্ধিত তদবিরকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ১১ হাজার তদবিরকারী। তাঁদের কাজ হলো, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের প্রভাবিত করে নিজ নিজ মক্কেলদের কাজ বাগিয়ে আনা। তবে তাঁদের সরকারের বেঁধে দেওয়া নীতিমালার ভেতরে থেকে এসব কাজ করতে হয়।
ভারতে একইভাবে তদবিরের বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু তদবির বা লবিংয়ের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা হয়, যার ফল সমাজের বেশির ভাগ লোক ভোগ করতে পারে। সেদিক থেকে বিবেচনা করে তাঁরা তদবিরকে আইনি কাঠামোবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা উচিত বলে মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.