আরেকটি সিরিজ জয়

জেমি সিডন্সের খুশির উপলক্ষ হতে পারে তিনটি—
অস্ট্রেলিয়ায় রেখে আসা নবজাতক পুত্রসন্তান টোবি, স্ত্রী কিম কন্যা স্টেলাকে নিয়ে ভালো আছেন। তার ওপর কাল বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকে ছাপা হয়েছে পরিবারের সবার ছবি। খুশি খুশি চেহারায় প্রথম আলোর কালকের স্টেডিয়াম পাতাটা সযত্নে ভাঁজ করে রেখে দিলেন হাতে।
হার দিয়ে শুরু করলেও বিশ্বকাপের আগে আরও একটা সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। সিডন্সের আনন্দিত হওয়ার এটাই বোধ হয় সবচেয়ে তাজা কারণ।
আর শুধু কি সিরিজই জিতল বাংলাদেশ, কোচ তো কাল ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবেও শতভাগ সফল! আগের দিনই বলেছিলেন, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেট বড়জোর ১৮০-২০০ রানের। জিম্বাবুয়ে দল যেন তাঁর কথা মেনেই ৫০ ওভারে করল ১৮৮ রান!
চট্টগ্রামে আসার পর থেকে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আর কর্দমাক্ত মাঠ দেখে দেখেই সময় কাটছিল সবার। পরশু ক্রিকেটীয় আবহাওয়াটা ফিরে আসার পর কালও গেল ঝা-চকচকে একটা দিন এবং সেই দিন শেষে বাংলাদেশ শিবিরে আনন্দের ফল্গুধারা। তবে চট্টগ্রামের উইকেট আর আউটফিল্ড নিয়ে যে আতঙ্কটা ছিল, সেটাকে সিরিজ জয়ের পরও সামনে নিয়ে এলেন কোচ। কথা ফলে যাওয়া আর সিরিজ জয়ের আনন্দ সে কারণেই মিলেমিশে একাকার।
আনন্দটা সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা তামিম ইকবালের। ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরি না পাওয়ার আফসোসকে এক পাশে রেখে দিলেও কালকের ৯৫ রানের ইনিংস তাঁর জন্য অন্যরকম গর্বের। নিজ শহর চট্টগ্রামের মাটিতে খেলা ওয়ানডেতে এটাই তামিমের সর্বোচ্চ ইনিংস। এই ইনিংসে মারা ৭টি ছক্কা দিয়েই তিনি নতুন করে লিখেছেন বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার নিজের পুরোনো রেকর্ডটি। তামিম চাইলে গর্বে বুকটাকে আরেকটু ফুলিয়ে নিতে পারেন এটা জেনে যে, বাংলাদেশের মাটিতে এখন পর্যন্ত এক ম্যাচে এর চেয়ে বেশি ছক্কা মারতে পারেনি কোনো বিদেশি ব্যাটসম্যানও।
তামিমের ৭টিসহ কালকের ম্যাচে ছক্কা হয়েছে মোট ৯টি। সংখ্যাটা জেনে চট্টগ্রামের মাঠ-উইকেটকে ভুল বুঝবেন না যেন। ম্যাচ শেষে তামিম যে বললেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছিল এক নেওয়াই বরং কষ্টকর, ছয় মারা সহজ। দুই দিন ধরেই আমি আপসেট ছিলাম স্লো আউটফিল্ড নিয়ে। মারলাম কিন্তু চার হলো না, নিজের কাছে তখন খুব খারাপ লাগে। এটা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম’, ওটাই আসলে বাস্তবতা।
বাউন্ডারির চেয়ে ছক্কা বেশি মেরে নিজের চিন্তা তামিম নিজেই দূর করে দিয়েছেন। তবে নার্ভাস নাইনটিজে গিয়ে আরেকটু ধৈর্য ধরলে বোধ হয় খারাপ হতো না। ইনিংসের ২৯তম ওভারের পঞ্চম বলে দেবাংওয়াকে শেষ ছক্কাটি হাঁকালেন লং অনের ওপর দিয়ে—৮৯ থেকে ৯৫। পরের বলটাও তুলে মারতে চাইলেন মিড উইকেট দিয়ে। কিন্তু ডিপ মিড উইকেটে ক্রেমারের হাতে ক্যাচ হয়ে গেল সেটি। সেঞ্চুরির সম্ভাবনারও কবর তাতেই।
‘তামিম শো’র কারণেই দলের মাত্র ৩ রানে ইমরুল কায়েসের কট বিহাইন্ড হয়ে যাওয়াটা বিপদের কারণ হয়নি বাংলাদেশের জন্য। বরং জুনায়েদ সিদ্দিকের (৫৬*) সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে তামিমের ১৩৬ রানের জুটি ১৮৯ রানের লক্ষ্যটাকে করে দেয় আরও সহজ। মাঝে রকিবুলের শূন্য রানে ফিরে যাওয়াটা কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তার ডালপালা ছড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যখন ম্যাচ শেষ করে দিয়ে আসারই চেষ্টা করেন ব্যাটসম্যানরা, রকিবুল তখন চার বল খেলেই মাসাকাদজার বলে স্লিপে ক্রেমারের ক্যাচ! তবে এরপর সাকিব-মুশফিকুররা ছিলেন বলে ম্যাচ জেতা নিয়ে সংশয় ছিল না। তবে ব্যাটিং-অর্ডারের চার নম্বর জায়গাটি নিয়ে যে এখনো চিন্তামুক্ত হওয়ার সময় আসেনি, পরপর দুই ম্যাচে ব্যর্থ রকিবুল যেন সেটাই জানিয়ে দিয়ে গেলেন! এই সিরিজের আগে সংশয় ছিল তিন নম্বর জায়গা নিয়েও। সিরিজে দুটি ফিফটি করে জুনায়েদ সিদ্দিক অবশ্য সেই দুশ্চিন্তা কিছুটা কমিয়েছেন।
জিম্বাবুয়ে দলের চেয়েও এই সিরিজে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল আসলে এ রকম কিছু বিষয়ই। জুনায়েদের মতো সেই চ্যালেঞ্জে সফল ইনজুরি কাটিয়ে ফেরা পেসার মাশরাফি বিন মুর্তজাও। ঢাকার তৃতীয় ওয়ানডেতে দুর্দান্ত বল করেছেন। ৮ ওভারে ২৫ রান দিয়ে ২ উইকেট—সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেন কালও। মাশরাফির দুর্ভাগ্য, উইকেট ২টির জায়গায় ৩টি হলো না জিম্বাবুয়ে ইনিংসের শেষ বলে ডিপ মিড উইকেটে সোহরাওয়ার্দী ক্যাচ ফেলে দেওয়ায়। এর আগে ২১ রানে ৩ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়েকে ১৮৮ রান এনে দিয়েছে মূলত ক্রেইগ আরভিন আর টাটেন্ডা টাইবুর ৯৫ রানের চতুর্থ উইকেট জুটি।
জীবন ফিরে পাওয়ার সৌভাগ্য বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরও ছিল। ২৪ রানে তামিমের দেওয়া ফিরতি ক্যাচ ধরতে পারেননি। জুনায়েদের ‘লাইফ’ ২০ রানের সময়। নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকা তামিমের সঙ্গে সংঘর্ষে নিজের বলে জুনায়েদের ক্যাচটা নিতে পারেননি বাঁহাতি স্পিনার রে প্রাইস। ভাগ্যের এই দুটি ছোঁয়া না পেলে ম্যাচের রং বদলেও যেতে পারত।
জয়ের দিনেই এসব তুচ্ছ হয়ে যায়, সিরিজ জয়ের দিনে তো আরও বেশি। তার পরও বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের জন্য এই সিরিজটা ছিল একটা ‘গিনিপিগ’। জেমি সিডন্সের গবেষণাগারে নিশ্চয়ই বাড়তি ‘মর্যাদা’ পাবে এসব ছোটখাটো ভুলও।

No comments

Powered by Blogger.